লোডশেডিংয়ের বৃত্তে সিলেট : ফুঁসে উঠছে মানুষ
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৪৫:১৯ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার : তীব্র গরমের সাথে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সিলেটের জনজীবন। দাবদাহের কারণে এমনিতেই হাঁসফাঁস অবস্থা জনজীবনে। এরমধ্যে দিনের ন্যায় রাতেও লোডশেডিং দুর্ভোগে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এতে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। বন্ধ হতে চলেছে ছোট-বড় কলকারাখানা। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হওয়া ও মানুষের কাজকর্ম স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে লোডশেডিং শুরু হওয়ায় সবার বিশেষ করে প্রবীণ ও শিশুদের কষ্ট দুর্ভোগ চরমে। হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।
এমন পরিস্থিতিতে জনমনে বাড়ছে ক্ষোভ। আল্টিমেটাম দিয়েছেন ব্যবসায়ীগণ। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতির দাবী জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন বিসিক শিল্পনগরী গোটাটিকরের শিল্প মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ।
তবুও, সহসাই বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি নিয়ে কোন সুখবর দিতে পারছেনা বিদ্যুৎ বিভাগ। উল্টো তাপমাত্রা বাড়লে লোডশেডিং বৃদ্ধির শঙ্কার কথা জানাচ্ছেন তারা। একমাত্র বৃষ্টিপাত বাড়লে তাপমাত্রা কমবে এতে কমবে বিদ্যুতের চাহিদা। সেদিকেই তাকিয়ে আছে জনসাধারণ।
এদিকে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নামায় রাজপথে নামার হুমকী দিয়েছেন সিলেটের ব্যবসায়ীরা। একই সাথে বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতির দাবী জানিয়ে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়েছেন তারা।
সোমবার রাতে এক যৌথ বিবৃতিতে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি সিলেট জেলা শাখা, সিলেট মহানগর ও জেলা ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের নেতৃবৃন্দ এই ঘোষণা দেন।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি সিলেট জেলা শাখার মহাসচিব ও সিলেট মহানগর ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের সভাপতি আব্দুর রহমান রিপন, দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি আব্দুল মুনিম মল্লিক মুন্না, আবুল হোসেন, যুগ্ম মহাসচিব আব্দুল হাদী পাবেল, আব্দুর রহমান দুদু, মারুফ আহমদ, মনিরুল ইসলাম, হোসেন আহমদ, মো. আব্দুস সোবহান, সাংগঠনিক সচিব নিয়াজ মো. আজিজুল করিম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আব্দুল কাইয়ুম, কোষাধ্যক্ষ মো. নাহিদুর রহমান, প্রচার সচিব তাহমিদুল হাসান জাবেদ এবং জেলা ব্যবসায়ী ঐক্য কল্যাণ পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক, সহ-সভাপতি মুফতি নেহাল উদ্দিন, শাহ আহমেদুর রব, নুরুল ইসলাম সুমন, মো. ছাদ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল আহাদ, সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. আলেক মিয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক আতিকুর রহমান সুহেদ এক বিবৃতি বলেন, সিলেটে অতিরিক্ত লোডশেডিং এর কারনে ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রতি আধা ঘন্টা পরপর লোডশেডিংয়ের কারণে প্রভাব পড়ছে ব্যবসা বাণিজ্যে। আমাদের ব্যবসায় মূল আকর্ষণ হলো ক্রেতা। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে ক্রেতাও আসেনা মার্কেটে। এতে করে আমাদের ব্যবসাতেও লোকসান হচ্ছে। এমতাবস্থায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে ব্যবসায়ীদের।
তারা বলেন, সিলেট বিভাগে ১৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও পুরো বিভাগের ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে মারাত্মক বৈষম্যের সম্মুখীন হচ্ছে সিলেটবাসী। সিলেটবাসীর প্রতি এরকম চরম বৈষম্য বন্ধ করতে হবে। সিলেটে সর্বনিম্ন বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে হবে। অবিলম্বে সিলেটে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান না হলে ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামার হুশিয়ারি উচ্চারণ করে করে বলেন নেতৃবৃন্দ, প্রয়োজনে বিদ্যুত অফিস ঘেরাও করা হবে। এতে করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা এড়াতে অবিলম্বে বিদ্যু সমস্যার সমাধান করতে হবে।
এদিকে ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে বিপাকে পড়েছেন বিসিক শিল্পনগরীর উদ্যোক্তারা। ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদনে নেমেছে ধস। এভাবে চলতে থাকলে উৎপাদন বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবেনা বলেন জানিয়েছেন উদ্যোক্তাগণ। দ্রুত বিদ্যুৎ পরিস্থিতির স্বাভাবিক করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবী জানান তারা।
সোমবার এক বিবৃতিতে সিসিক শিল্প মালিক সমিতি গোটাটিকর এর সভাপতি কাজী মঈনুল হোসেন ও সেক্রেটারী আলীমুল এহছান চৌধুরী বলেন, গোটাটিকর বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় কোল্ড স্টোরেজ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প, কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক শিল্পসহ বিভিন্ন ধরণের প্রায় ৪৫টি শিল্প কারখানা রয়েছে। প্রতিদিন সেখানে চলছে উৎপাদন কার্যক্রম। এসব কারখানায় প্রায় ২৫০০ জন শ্রমিক কর্মরত আছেন। বিগত ১ সপ্তাহ থেকে উক্ত শিল্পনগরী এলাকা ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে পরেছে। আগে যেখানে সারা মাসে ১৫-২০ ঘন্টা লোডশেডিং হত। সেখানে এখন দৈনিক ৪-৫ ঘন্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এভাবে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যবস্থা মারাত্নক ব্যাহত হচ্ছে ও প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তারা বলেন, উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দিতে পারছে না। এছাড়া ব্যাংক লোনের টাকায় নির্মিত প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে নিয়মিত লোন পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছেনা। সরকার নির্ধারিত ভ্যাট-ট্যাক্সের অর্থ পরিশোধ করা দিন দিন অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিদুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, প্রধান প্রকৌশলীর সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। এমন অবস্থা বেশিদিন চলতে থাকলে কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি হবে, বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করবে, শিল্প কারখানার মুনাফার উপর চাপ পড়বে, আয়- প্রবৃদ্ধি ও সরকারি আয়-রাজস্ব প্রাপ্তির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই উক্ত অবস্থার উন্নয়ন একান্তভাবে প্রয়োজন। এজন্য অন্তর্র্বতীকালিন সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তারা।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সিলেট বিভাগে পিডিবির বিদ্যুৎ চাহিদা ছিল ২১৭ মেগাওয়াট। বরাদ্দ দেয়া হয় ১৬০ মেগাওয়াট। ৫৭ মেগাওয়াট ঘাটতি থাকায় বিভাগে ২৭ শতাংশ লোডশেডিং করতে হয়েছে।
এছাড়া সিলেট জেলায় ১৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয় ৯০ মেগাওয়াট। ৪১ মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতির জন্য জেলায় ২৯ শতাংশ লোডশেডিং করতে হয়েছে।
এর আগে সোমবার সিলেট বিভাগে পিডিবির চাহিদা ছিল ২১৪.৭০ মেগাওয়াট, এর বিপরীতে সরবরাহ ছিলো ১৬০.৫০ মেগাওয়াট। সেক্ষেত্রে ঘাটতি ছিলো ৫৪.৩০ মেগাওয়াট যা মোট চাহিদার ২৫.২৯ শতাংশ। অন্যদিকে একইদিন সিলেট জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিলো ১৪১.৫০ মেগাওয়াট, বিপরীতে সরবরাহ ছিলো ৯৮.৯৪ মেগাওয়াট, সেক্ষেত্রে ঘাটতি ৪২.৫৬ মেগাওয়াট যা মোট চাহিদার ৩০.০৭ শতাংশ।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সিলেটের প্রধান প্রকৌশল আব্দুল কাদির দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। জাতীয় গ্রিড থেকে লোডশেডিং ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় বিদায় আমাদের কিছু করার নেই। মঙ্গলবার বিদ্যুৎ বিভাগের একটি অভ্যন্তরীণ সভা হয়েছে। ওই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সিলেটের বিদ্যুতের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি কেন্দ্রকে জানানো হবে। এরপর করনীয় কেন্দ্র থেকেই ঠিক করা হবে।