লোডশেডিংয়ে গ্রাম-শহর একাকার
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩:০০:৩৩ অপরাহ্ন
# দেশে ৩ হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি
# সিলেটে ঘাটতি ৩০ শতাংশ
# ২০ দিনের মধ্যে লোডশেডিং কমবে : বিদ্যুৎ উপদেষ্টা
জালালাবাদ রিপোর্ট : কিছুদিন আগে বানের জলে ছিলো গ্রাম-শহর একাকার। এর রেশ কাটতে না কাটতেই বিদ্যুতের লোডশেডিংয়েও গ্রাম-শহর একাকার। সমানতালে ঘন্টার পর ঘন্টা হচ্ছে লোডশেডিং। আর মানুষের কষ্টের সীমা অতিক্রম করেছে। যদিও গতকাল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে লোডশেডিং কমবে।
বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। প্রশ্ন উঠেছে, বিদ্যুতের চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও হঠাৎ করে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণ কী?
বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গরম বাড়লেই চাপে পড়ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারেনা তারা। এখন জ্বালানি ও ডলারের সংকটে লোডশেডিং পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বৃষ্টি হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
বিদ্যুৎ সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সোমবার রাতে সারাদেশে আড়াই হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হয়েছে। গ্যাস সরবরাহ বাড়েনি। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও কম সরবরাহ হচ্ছে। এর মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ইউনিট। এতে মঙ্গলবার ৩ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে লোডশেডিং।
আর সিলেটে গড় লোডশেডিংয়ের হার ৩০ শতাংশ। গতকাল বুধবারও ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশের মতো লোডশেডিং হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সিলেট অঞ্চলে চাহিদার ২০৭ দশমিক ৫০ মেগাওয়াটের বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ১৪৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ আসে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট। প্রয়োজনের সময় আগে সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এখন ৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। পিডিবি বলছে, দিনে ১২০ থেকে ১৩০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ পেয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এখন সরবরাহ হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ কোটি ঘনফুট।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের মাধ্যমে দিনে গ্যাস আসে ১১০ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল গত ২৭ মে থেকে বন্ধ। এতে এখন সরবরাহ হচ্ছে ৬০ কোটি ঘনফুট। ১২ সেপ্টেম্বর টার্মিনাল চালু হতে পারে।
একক বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ভারতের ঝাড়খন্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র। দিনে দেড় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে তারা। তারা এখন সরবরাহ করছে এক হাজার মেগাওয়াট।
পিডিবি ও আদানির দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, লোডশেডিং কমাতে পাওনা পরিশোধে সোনালী ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সোমবার ৮০ লাখ ডলার ও মঙ্গলবার ২০ লাখ ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। বুধবার আরও কিছু পরিশোধ করা হয়েছে। তবে বকেয়ার তুলনায় এটা তেমন কিছুই না। দিনে ৩০ লাখ ডলার পাওনা হয় আদানির। তাই তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে রাজি হচ্ছে না। আরও কিছু বিল পরিশোধ করা হলে সরবরাহ বাড়তে পারে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বলেন, গ্যাসের সরবরাহ বাড়ছে না। চাহিদামতো ডলারও পাওয়া যাচ্ছে না। এর মধ্যে গরম বেড়ে যাওয়ায় একটু বিদ্যুৎ ঘাটতি হচ্ছে। তেলচালিত কেন্দ্র থেকে উৎপাদন বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি অনেক বেশি হলে রাজধানী ঢাকাতেও লোডশেডিং করতে হয়। ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) ও ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো)। এ দুটি সংস্থার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ঢাকায় আগের দিনের চেয়ে লোডশেডিং বেড়েছে।
ঢাকার বাইরে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শহর এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। তবে বেশি হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। ৬টি বিতরণ সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। এ সংস্থাটির তথ্য বলছে, গতকাল ঢাকার আশপাশের এলাকাতে ৩৮ শতাংশ ঘাটতি ছিল তাদের। কুমিল্লায় ৩৭ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৩৫ শতাংশ, রাজশাহীতে ৩৩ শতাংশ, সিলেটে ২৮ শতাংশ এবং রংপুরে ২৬ শতাংশ বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল আরইবির।
২০ দিনের মধ্যে লোডশেডিং কমবে :
আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে লোডশেডিং কমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, লোডশেডিং দূর করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে।
গতকাল বুধবার সচিবালয়ে ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি) নির্বাহী কমিটির সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, একসঙ্গে কয়েকটি ঘটনা ঘটায় লোডশেডিং হচ্ছে। হঠাৎ বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। একই সময়ে রামপালের একটি ইউনিটে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছে। গ্যাস সরবরাহ ঠিক থাকলে এই সংকট সামাল দেওয়া সহজ হতো। কিন্তু সামিট গ্রুপের এফএসআরইউ (ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল) কয়েক মাস ধরে বিকল থাকায় গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। এলএনজি আমদানির কাজ চলছে, ১৫-২০ দিনের মতো সময় লাগবে। তারপর গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে।
তিনি বলেন, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও রামপাল দ্রুত চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করছি ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উন্নতি হবে। ধারণা করছি ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
এ সময় বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান বলেছেন, বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে পাম্পটি বিকল্প হয়েছে, সেটি প্লেনে করে চীন থেকে আনা হচ্ছে। রোববারের মধ্যেই চালু হয়ে যাবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিকল ইউনিট দ্রুত চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপের পাওনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে অর্থের সংকট নেই। আমরা সোনালী ব্যাংকে ১০০ মিলিয়ন টাকা দিয়ে দিয়েছি। তারা ডলারের অভাবে দিতে পারছে না। আমরা আরও টাকা দিতে পারি। আশাকরি আদানির বিদ্যুৎ পেতে কোনো সমস্যা হবে না।