ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার নাজির: জাতিকে নতুন সংবিধান উপহার দেয়া সময়ের দাবি
প্রকাশিত হয়েছে : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭:১৪:৫১ অপরাহ্ন
ঢাকা থেকে সংবাদদাতা: জাতীয় প্রেসক্লাবে জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বৃটিশ সুপ্রীম কোর্টের প্রতিথযশা আইনজীবী ও লন্ডনের নিউহ্যাম বারার সাবেক ডেপুটি স্পীকার ব্যারিস্টার নাজির আহমদ বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিৎ অবিলম্বে সংবিধান সম্পর্কে তারা কি করতে যাচ্ছেন তা জাতিকে বিস্তারিতভাবে জানানো। দেরি করলে গণ-অভ্যূত্থান থেকে সৃষ্ট প্রত্যাশা আস্তে আস্তে হ্রাস পাবে। জাতি সংবিধান নিয়ে অনেকটা ধূয়াশার মধ্যে আছে। এই ধূয়াশাই সৃষ্টি করে গুজব, উৎকন্ঠা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে মেরামত ও দেশকে অবারিত সম্ভাবনার পথে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের দরকার নতুন, যুগোপযোগী আধুনিক ও গতিশীল সংবিধান।
ব্যারিস্টার নাজির আরও বলেন, গত ১৫ বছরে পতিত স্বৈরশাসক নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ও চুড়ান্ত কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠতে সংবিধানকে কাঁটাছেড়া করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল যে একজন নাগরিক চাইলেও সংবিধান সঠিকভাবে অনুসরণ করে চলতে পারবেনা। সেটা না ভেঙ্গে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়ে পড়েছেন বেশ গ্যাঁড়াকলে। তারাও দৃশ্যত: সংবিধানের কিছু অংশ মানছেন বা মানতে পারছেন আবার অন্য অংশ কিংবা বহু অংশ মানছেন না বা মানতে পারছেন না।
বর্তমান সংবিধানের বিভিন্ন ধরণের অসঙ্গতি ও দূর্বলতা তুলে ধরে ব্যারিস্টার নাজির আহমদ বলেন, সংবিধান যে কি আজগুবি অবস্থায় আছে তা কয়েকটি উদাহরণ দিলে পরিস্কার হবে। প্রথমত: সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ না ভেঙ্গে নির্বাচন করা যাবে, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিরল ও নজীরবিহীন । দ্বিতীয়ত: সংবিধানের ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, রদ, ষড়যন্ত্র ও সর্বোচ্চ শাস্তির কথা এমনভাবে লিখে সন্নিবেশিত করা হয়েছে যে পতিত সরকার বা তাদের কোন দোসর যদি কোনভাবে ক্ষমতায় আসতে পারে তাহলে বর্তমান অন্তর্র্বতীকালীন সরকারে সম্পৃক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবে। তৃতীয়ত: সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। কিন্তু স্পিকার যদি অসমর্থ বা অনুপস্থিত হন তাহলে কে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন এই বিষয়টি সংবিধান অনুধাবন করেনি। চতুর্থত: সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদে অনেক বিধান আছে যা সরাসরি মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের অন্যান্য অনুচ্ছেদের সরাসরি বিপরীত ও সাংঘর্ষিক। পঞ্চমত: সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদ সংবিধানের প্রায় এক তৃতীয়াংশ সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণ অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
ব্যারিস্টার নাজির বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শতাব্দির সবচেয়ে বড় গণ-অভ্যূত্থান থেকে জন্ম নেয়া বর্তমান সরকারকে সংবিধান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। আশার কথা যে সরকার এ সম্পর্কে ড. শাহ্দীন মালিককে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করেছেন। আমরা এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখতে চাই। সংবিধান নিয়ে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের সামনে মোটাদাগে তিনটি অপশন খোলা। এগুলো হলো-প্রথমতঃ
গত ১৫ বছরে কাঁটাছেড়া সংবিধানের স্হলে সম্পূর্ণ নতুন একটি সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়া। নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ আসনে সাংবিধানিক সংসদ গঠন করা। এটির একমাত্র কাজ হবে সংবিধান রচনা ও গ্রহন করা। এর সাথে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য একইসাথে গণভোটের আয়োজনও করা যেতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানের শুরু ও যাত্রা ছিল গলদপূর্ণ। ১৯৭২ সালের সংবিধানকে এডপ্ট করার জন্য ১৯৭০ সালের পাকিস্তান আমলের লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক এর অধীনে নির্বাচিত এমপি দ্বারা গঠন করা হয় সাংবিধানিক সংসদ। এখন প্রশ্ন হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে খোদ পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়া দেশের সংবিধান রচনা ও অনুমোদন সেই পাকিস্তানের সংবিধান ও লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক এর অধীনে নির্বাচিত এমপিরা করেন কিভাবে? এই যৌক্তিক প্রশ্নটি উত্থাপন করেছেন বাংলাদেশের সাবেক মেধাবী প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ঢাকার এক সেমিনারে।
দ্বিতীয় অপশন- অনুমান ৫০/৬০ জন বিশেষজ্ঞ সংবিধান প্রণয়ন কমিটি বা কমিশন গঠন করা যাদের একমাত্র দায়িত্ব হবে নতুন একটি সংবিধান ড্রাফট করা। এই নতুন সংবিধান সুষ্ট, অবাধ ও অংশগ্রহনমূলক গণভোটের মাধ্যমে গৃহিত হবে। একই সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ, স্থায়িত্ব ও চলমান কাজের বৈধতার জন্য গণভোটের আয়োজনও করা যেতে পারে, যেভাবে বৃটেনে একদিনে একাধিক নির্বাচন হয়।
তৃতীয় অপশন: ১/১১ সরকারের মতো এই সরকার পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের উপর নির্ভর করবে। অর্থাৎ ১/১১ সরকারের মতো এ সরকার যতদিন থাকবে পরবর্তী সরকার এসে তাদের মেয়াদ, চলমান কার্যাবলী ও সংবিধান পরিবর্তনের বৈধতা দেবে। প্রথম বা দ্বিতীয় অপশন গ্রহন করার যৌক্তিকতা ব্যখ্যা করে ব্যারিস্টার নাজির আহমদ বলেন, প্রথম অপশন বা দ্বিতীয় অপশনে যাওয়া হবে উত্তম। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর সফল গণ-অভূত্থানের মাধ্যমে আসা জাতির জন্য এমন সুযোগ আর নাও আসতে পারে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাতিকে নতুন একটি সংবিধান উপহার দেয়া সময়ের দাবী।
এক প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার নাজির আহমদ বলেন, নতুন সংবিধান রচনা করা তো দূরের কথা, রাজনৈতিক সরকার তাদের স্বার্থ ছাড়া সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনে হাত দিবে না। উল্লেখ্য গত ৫৩ বছরে সংবিধানকে ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। এর বেশিরভাগই করা হয়েছে ব্যক্তি, দলীয় ও নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে।
তিনি আরও বলেন, অনেক সময় রাজনৈতিক সরকারের ইচ্ছা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্বেও আমলাদের প্রচন্ড চাপে সরকার সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করতে পারে না।