ড. ইউনুসসহ সরকারের সাথে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সিরিজ বৈঠক : বাংলাদেশকে সহায়তায় প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯:৩৩:৩৪ অপরাহ্ন
২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা, চুক্তি সই
জালালাবাদ রিপোর্ট : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাই প্রোফাইল প্রতিনিধি দলের সাথে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনুসসহ সরকারের সিরিজ বৈঠক হয়েছে। রোববার এসব বৈঠকে বাংলাদেশকে আরও ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত বলে জানানো হয়েছে। একইসাথে বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার খাতে ২০০ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) চুক্তি সই হয়েছে।
শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আসে। আর বিকেলে দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসেন প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো ঢাকা সফরে এসেছে উচ্চ পর্যায়ের মার্কিন প্রতিনিধিদল।
প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক, বাংলাদেশকে সহায়তায় প্রস্তুত :
রোববার সকাল ১১টায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকা সফররত মার্কিন প্রতিনিধি দল।রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক হয়। ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন ট্রেজারি বিভাগের আন্তর্জাতিক অর্থ বিষয়ক সহকারী আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান। নেইম্যানের সঙ্গে ছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
বৈঠকের বিষয়ে ঢাকা মার্কিন দূতাবাসের ভেরিফাইড ফেসবুকে এক পোস্টে লেখা হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রতিষ্ঠান গঠন ও উন্নয়ন সহযোগিতার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন আমাদের প্রতিনিধিদল। ‘যেহেতু বাংলাদেশ আরও ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে চাইছে, যুক্তরাষ্ট্র সেই প্রচেষ্টায় সহায়তা করতে প্রস্তুত’, বলা হয়েছে ওই পোস্টে।
বৈঠকে বাংলাদেশের পুনর্গঠন, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এবং পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার স্বৈরশাসনের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজদের সম্পদ (যা বিদেশে পাচার করা হয়েছে) দেশে ফেরত আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, বর্তমান প্রশাসন অর্থনীতিকে সংস্কার এবং পুনরায় সচল করতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। আর্থিক খাতে সংস্কার এবং বিচার বিভাগ ও পুলিশের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং আমাদের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।
ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনৈতিক সংস্কার, বিনিয়োগ, শ্রমিক ইস্যু, রোহিঙ্গা সংকট এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন নিউইয়র্ক সফর নিয়ে আলোচনা হয়।
অর্থ উপদেষ্টার সাথে বৈঠকে ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা :
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাষ্ট্র।রোববার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠকের পর অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বা ইউএসএআইডির মাধ্যমে এ অর্থ দেয়া হবে।
এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং ইউএসএআইডির মধ্যে থাকা একটি চুক্তি রোববার পুনঃনবায়ন হয়েছে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, আগে যে চুক্তি হয়েছিল, সেখানে ২০০ মিলিয়ন ডলার নতুন করে যোগ করা হয়েছে। মূলতঃ বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার খাতে যুক্তরাষ্ট্র এ অর্থ সহায়তা দেবে। এছাড়া দেশটির সাথে বাংলাদেশের আগের সব চুক্তি চলমান থাকবে। বৈঠকে আর্থিক খাতে আরো সহযোগিতা, দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ওয়াশিংটনের সহায়তা চেয়েছে ঢাকা।
অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, আমাদের সাথে মূলত মার্কিন ফেডারেল ডিপার্টমেন্ট এবং ইউএসএআইডি’র আলাপ হয়েছে। আর্থিক খাতে যেসব সহযোগিতা দরকার সেসব বিষয়ে আলাপ হয়েছে এবং দ্বিতীয় হল বাণিজ্য এগিয়ে নেয়া।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, সুশাসন, মানবিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি ও মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এই অর্থ কাজে লাগানো হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার হলো বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে সহযোগিতা করা।
অর্থ উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। মূলত রাজস্ব ও আর্থিক খাত নিয়ে কথা হয়েছে। আর্থিক খাতের সংস্কার ও সহযোগিতা নিয়ে কথা হয়েছে। বাণিজ্য নিয়েও কথা হয়েছে; রপ্তানি বহুমুখীকরণসহ অন্যান্য কারিগরি সহায়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাজার অনুসন্ধানও আলোচনায় এসেছে। বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে তারা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র মূলত ইউএসএআইডি ও ইউএসডিএর মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগিতা দিয়ে থাকে। ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত ও সম্পর্কিত সহায়তা শীর্ষক একটি চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, সুশাসন, খাদ্যনিরাপত্তার মতো বিভিন্ন খাতে আজ পর্যন্ত ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে।চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সই করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম সাহাবউদ্দিন এবং ইউএসএআইডির পক্ষ থেকে সই করেন রিড জে অ্যাসচলিম্যান।
পররাষ্ট্র সচিবের সাথে বৈঠকে সংস্কার পরিকল্পনা জানতে চেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র :
ঢাকা সফররত মার্কিন প্রতিনিধিদল অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব এম জসীম উদ্দিন। রোববার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা জানান।
সচিব জানান, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার তারা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা সম্পর্কে তারা জানার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি এ সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকার বিবেচনায় আর্থিক খাত ও রাজস্ব খাতে সংস্কারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা। একই সঙ্গে শ্রম পরিবেশ, মানবাধিকার সুরক্ষা, রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তাসহ নানা বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি।
আলোচনার বিষয়ে জসীম উদ্দিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তরের সহকারী আন্ডারসেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করছে। কিছুক্ষণ আগে তাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছি। বৈঠকে দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। ছাত্র-জনতার চরম আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশে সূচিত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সরকার ইতোমধ্যে যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন সে সমস্ত পদক্ষেপ সম্পর্কে আমরা প্রতিনিধি দলকে অবহিত করেছি।
বৈঠকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব, রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, বাণিজ্য সচিব, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাত ভালো লেগেছে :
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে ভালো লেগেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস। দূতাবাসের ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, আমরা আমাদের অংশীদার বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক কর্মকা- সম্প্রসারণ, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
রোববার সকাল সাড়ে ৯ টায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। যার নেতৃত্ব ছিলেন দেশটির ট্রেজারি বিভাগের আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বিষয়ক ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যান।