এবারও ডেঙ্গু ঢেউ! চলতি বছরের ১০৮ মৃত্যু
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১০:০৮ অপরাহ্ন
হাসপাতালে ১৯ হাজার, সিলেটেও ১১
জালালাবাদ রিপোর্ট : প্রথমবার মা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন নার্সিং কলেজের ছাত্রী উম্মে হানি আকতার (২২)। একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন কাঙ্খিত সেই দিনের দিকে। ১৪ অক্টোবর ছিল সম্ভাব্য সেই ক্ষণ; কিন্তু তার আগেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সোমবার ভোররাতে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে অন্তঃসত্ত্বা এই নারীকে।
উম্মে হানির বাড়ি খাগড়াছড়ির গুইমারা এলাকায়। স্বামী মোহাম্মদ জুয়েলসহ চট্টগ্রামের লালখান বাজারে থাকতেন। নিজ বাসাতেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন তাঁরা। এরপর বৃহস্পতিবার নগরের পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তি হন।
শুধু উম্মে হানি-ই নয়, ডেঙ্গুতে নিরবে ঝরছে প্রাণ। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২৫ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজারেরও বেশি। এর আগে গত আগস্টে মৃত্যু ছিল ২৭ জন।
সব মিলিয়ে চলতি বছরের এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এরমধ্যে দুই সিটিতে ৭২ জন এবং রাজধানীর বাইরে ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছরে এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৩৪২ জন। এর মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ৮ হাজার ৬৯৯ জন। এছাড়া রাজধানীর দুই সিটি এলাকার বাইরে ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগে ১০ হাজার ৬ জনেরও বেশি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। এবারও বর্ষার শুরু থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ২০২৪ সালে অর্থাৎ এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি বছরের শুরু থেকেই অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। তবে এর ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা দেখা যায় জুলাই মাসে। আর চলতি মাসে তা সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
এখন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৫৫ শতাংশই ঢাকার বাইরে। এবার আক্রান্তদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। তবে নারীদের ক্ষেত্রে এবার ডেঙ্গুর ‘এক্সপান্ডেড সিনড্রোম’র সঙ্গে নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে হাইপোটেনশন বা নিম্ন রক্তচাপ। মারা যাওয়া নারীদের বেশিরভাগই নিম্ন রক্তচাপের সমস্যায় ভুগেছে।
ডাক্তাররা জানিয়েছেন, জেনেটিক কারণে নারীদের ডেঙ্গুতে মারা যাওয়ার হার বেশি। এছাড়া গর্ভাবস্থায় ও ঋতুস্রাবকালে কোনো নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে তাদেরও মৃত্যু ঝুঁকি বেশি থাকে। এক্সপান্ডেড সিনড্রোমের মধ্যে রোগীর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, প্রেসার কমে যাচ্ছে এবং শকে চলে যাচ্ছে। ফলে প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে এবং রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। মূলত নারীদের অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়। সংসারের চাপে নিজের স্বাস্থ্যের প্রতিও খেয়াল রাখেন না তারা। তাদের যখন ডেঙ্গু জ্বর হয় তখন সাধারণ জ্বর মনে করে সময়ক্ষেপণ করেন। আর এতেই পরিস্থিতি জটিল হয়ে মৃত্যুদশায় চলে যায় রোগী।
এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, গর্ভবতী নারী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে, তাদের প্রসব জটিলতা অন্য নারীদের চেয়ে বেশি দেখা দেয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১৬ শতাংশ নারী মৃত সন্তানের জন্ম দেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, এআরডিএস অর্থ ফুসফুসকে ইনভলভ করা। এটা সাধারণত কোভিডের ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু ডেঙ্গুতেও এখন এটি হচ্ছে। এক্সপান্ডেড সিনড্রোম যখন দেখা দেয়, তখন রোগীর লিভার, কিডনি, ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রেসার কমে যায়, রোগী শকে চলে যায়।
এ বছরের এ পর্যন্ত ডেঙ্গুর মাসভিত্তিক আক্রান্তের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে ১ হাজার ৫৫ জন আক্রান্ত ও ১৪ জনের মৃত্যু হয়। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ৩৩৯ ও মৃত্যু ৩, মার্চে আক্রান্ত ৩১১ ও মৃত্যু ৫, এপ্রিলে আক্রান্ত ৫০৪ ও মৃত্যু ২, মে মাসে আক্রান্ত ৬৪৪ ও মৃত্যু ১২, জুনে আক্রান্ত ৭৯৮ ও মৃত্যু ৮ জনের মৃত্যু হয়।
এ ধারায় পরিবর্তন আসে জুলাই মাসে। জুলাইয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৬৬৯ জনে। এসময় মৃত্যু ঘটে ১২ জনের। আগস্টে আক্রান্ত হয় ৬ হাজার ৫২১ ও মারা যায় ২৭ জন। আর চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৬ হাজার ৫০১ জন এবং মারা গেছেন ২৫ জন।
আক্রান্তের এলাকাভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৫ হাজার ২৮ জন রোগী ভর্তি হয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। ৪ হাজার ৭১১ জন ডেঙ্গু রোগী নিয়ে পরবর্তী অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এছাড়া ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৩ হাজার ৫০৭ জন, ঢাকা বিভাগে ২ হাজার ২২ জন, বরিশাল বিভাগে ১ হাজার ৯১২ জন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪৫ জন, গাজীপুর সিটি করপোরেশনে ৩ জন, খুলনা বিভাগে ১ হাজার ৩৬৯ জন, ময়মনসিংহে ৩৯৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ২৩২ জন, রংপুর বিভাগে ১০৬ জন, সিলেট বিভাগে ১১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গত বছর এক হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এই রোগে মারা গেছেন, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এছাড়া তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে ঢাকা, সিলেটসহ বড় কোন নগরেই মশা মারা হচ্ছে না। নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম নেই। বিশেষজ্ঞরা আগেই আশঙ্কা করেছিলেন, আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। তাদের আশঙ্কাও সত্যিই হতে চলেছে। গত দুই মাসের প্রতিবেদনে তা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ডেঙ্গু বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একপ্রকার ‘ননফাংশনাল’ (অকার্যকর)। ডেঙ্গু প্রতিরোধে তাদের কোনো সাড়া লক্ষ করা যাচ্ছে না।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গু ঢেউয়ের মতো। গত বছর একটা বড় ঢেউ গেছে, এ বছর একটু কম হলেও ঢেউ কিন্তু বাড়ছে।