সাংবাদিক তুরাব হত্যার ২ মাস: দস্তগীর-আজবাহারসহ খুনীরা কোথায়?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫:২২ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল: ১৯ জুলাই দিনটি ছিল শুক্রবার। জুমআ’র নামাজ শেষ হতেই মিছিল বের করে বিএনপি। কোন উত্তেজনার ন্যূনতম আঁচ নেই, পরিস্থিতি ছিল স্বাভাবিক। নিত্যদিনের মতো সেদিনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিকগণ। পাশেই ছিল পুলিশের সশস্ত্র অবস্থান। হঠাৎই অতিউৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তা এসএমপির সহকারী কমিশনার সাদেক কাউসার দস্তগীরের মারমুখী আচরণে বদলে যায় পরিস্থিতি। উত্তপ্ত হয়ে উঠে কোর্ট পয়েন্ট এলাকা। ঐ পুলিশের কিলিং মিশনের টার্গেটে পড়ে যান সাংবাদিক এটিএম তুরাব।
দৈনিক জালালালাবাদের স্টাফ রিপোর্টার ও দৈনিক নয়া দিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান এটিএম তুরাব সেদিন সড়কের রেলিংয়ে এক হাত দিয়ে ধরে অন্য হাতে মোবাইল ক্যামেরায় দেহে প্রেস লেখা জ্যাকেট (ভেস্ট) ও হেলমেট পড়ে বিএনপির মিছিল ও পুলিশের অবস্থানের মাঝখানে ভিডিও ধারণ করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ ‘বিগড়ে’ যান এসএমপির ভয়ংকর এডিসি দস্তগীর। কনস্টেবলের হাত থেকে একটি বন্দুক নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়া শুরু করলেন। তার গুলির নিশানা ছিল সাংবাদিক তুরাব। তখন দস্তগীরের দেখাদেখি অন্য পুলিশ সদস্যরাও বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ে। পুলিশের ছুঁড়া ৯৮টি ছররা গুলি বিদ্ধ হয় তুরাবের শরীরে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেন তার সহকর্মীরা। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে জরুরী ভিত্তিতে সোবহানীঘাট ইবনে সিনা হাসপাতালে আনা হয়। সেখানেই আইসিইউ-তে থাকা অবস্থায় সাংবাদিক তুরাব সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন।
তুরাবের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ও সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা: শামসুল ইসলাম বলেন, তুরাবের শরীরে ৯৮টি ছররা গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। গুলিতে তার লিভার ও ফুসফুস আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মাথায়ও আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ কারণেই তার মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।
আজ ১৯ সেপ্টেম্বর তুরাব হত্যাকান্ডের ২ মাস পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সিলেটের সকল মহলের প্রিয় সম্ভাবনাময় সাংবাদিক তুরাব নিহতের ২ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো গ্রেফতার হয়নি কোন খুনী, এমনকি তুরাব হত্যার সাথে জড়িত তৎকালিন এডিসি দস্তগীর ও উপকমিশনার আজবাহার আলীকে এখনো বরখাস্ত করা হয়নি। অথচ ৫ আগস্ট পরবর্তী বর্তমানে দেশ পরিচালনা করছে ছাত্র-জনতার মনোনীত অন্তর্বর্তীকালিন সরকার। ২ মাসেও তুরাবের কোন খুনীকে গ্রেফতার না করতে পারায় ক্ষুব্ধ সিলেটের নাগরিক ও সাংবাদিক সমাজ। বিক্ষুব্ধ তুরাবের পরিবার।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতন ও শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশের মতো সিলেটেও ঝরেছে একাধিক প্রাণ। মৃত্যুর মিছিল থেকে বাদ যাননি সাংবাদিকও। সব হত্যার বিচার হবে- প্রধান উপদেষ্টা, সেনা প্রধানসহ সরকারের উপদেষ্টাদের এমন আশ^াসে আশায় বুক বাঁধছিলেন তুরাবের পরিবার ও সাংবাদিক সমাজ। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন কার্যক্রম চোখে না পড়ায় বিচারের আশা ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
জানা গেছে, পুলিশের গুলিতে সাংবাদিক তুরাব নিহতের ঘটনায় গত ২৪ জুলাই পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ তা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে নথিভুক্ত করে। জিডির ব্যাপারে তৎকালিন কোতোয়ালি থানার ওসি মঈন উদ্দিন শিপন বলেছিলেন, ‘কার এবং কোন দিক থেকে আসা গুলি বিদ্ধ হয়ে তুরাব মারা গেছেন, এসব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে। এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে আগেই একটি মামলা করা হয়েছে। সেটির তদন্ত চলছে। পরিবারের পক্ষ থেকে করা অভিযোগটি আমরা রেখেছি এবং জিডি হিসেবে রেকর্ড করেছি। পরিবারের লিখিত অভিযোগ ও পুলিশের মামলাকে সমন্বয় করে তদন্ত এগোচ্ছে। এরপর থেকেই অনেকটা ধামাচাপা পড়ে যায় তুরাব হত্যা মামলা।
৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গত ১৯ আগস্ট সিলেটের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক আব্দুল মোমেনের আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের ভাই আবুল হাসান মো. আজরফ (জাবুর)। মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সিলেট মহানগর পুলিশের (এসএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (ক্রাইম, উত্তর) মো. সাদেক দস্তগীর কাউছার, উপকমিশনার (উত্তর) অতিরিক্ত ডিআইজি আজবাহার আলী শেখসহ ১৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া মামলায় আরো ২০০ থেকে ২৫০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
মামলায় আরো যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন- এসএমপির কোতোয়ালি থানার সহকারী কমিশনার (এসি) মিজানুর রহমান, বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কল্লোল গোস্বামী, কোতোয়ালি থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঈন উদ্দিন, পরির্দশক (তদন্ত) ফজলুর রহমান, এসআই কাজী রিপন আহমদ, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আপ্তাব উদ্দিন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতি পীযূষ কান্তি দে, সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি ও ৩২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রুহেল আহমদ, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল দাস অনিক, সাজলু লস্কর, শিবলু আহমদ, সেলিম মিয়া, আজহার, ফিরোজ ও উজ্জ্বল।
এদিকে, আদালতে মামলা দায়েরের ১ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মামলার কোন অগ্রগতি দেখা যায়নি। গ্রেফতার করা হয়নি কোন আসামীকে। তুরাব হত্যা মামলার আসামীদের কয়েকজন ইতোমধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে আর কয়েকজন আত্মগোপনে রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। খুনীদের গ্রেফতারে পুলিশের ভুমিকা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। ক্ষোভ জানিয়েছেন তুরাবের পরিবার।
মামলা এফআইআর হওয়ার পর ১ মাসেও আসামী গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন সাংবাদিক এটিএম তুরাবের ভাই আবুল আহসান মোঃ আজরফ (জাবুর)। তিনি বলেন, আমার ভাই হত্যার ২ মাস সময় পার হয়েছে। মামলা এফআইআর হওয়ার পর আরো ১ মাস চলে গেছে এরপরও আসামী গ্রেফতার না হওয়ায় আমরা বিস্মিত। এর মাধ্যমে পুলিশের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আমার ভাইয়ের হত্যার সাথে তো সব পুলিশ জড়িত নয়। তাহলে আসামীদের গ্রেফতার করা হচ্ছেনা কেন?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২১ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ব্যাপক সমালোচিত এসএমপির উপ পুলিশ কর্মকর্তা আজবাহার আলী শেখ (পিপিএম)-কে সিলেট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাকে রাজশাহী রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সুপারনিউমারারি অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে সংযুক্ত করা হয়েছে। সেখানে যোগদানের পর ছুটি নিয়ে আর কর্মস্থলে যাননি বলে জানিয়েছে সেখানকার একটি সূত্র। ফলে আজবাহার দেশে আছেন না কি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন ব্যাপারটি নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার মো: সাদেক দস্তগীর কাউছারসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের বেশকিছু নেতাকর্মী জকিগঞ্জ বর্ডার হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন। তাদেরকে একজন বিতর্কিত সাবেক এমপি বর্ডার পার হতে সহযোগিতা করেছেন বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
বিতর্কিত এডিসি সাদেক কাউসার দস্তগীরকে ৫ আগস্টের পর আর কোথাও দেখা যায়নি বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে প্রথমে তাকে পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছিলো। পরে শেরপুরে পুলিশ ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়। কিন্ত তার কর্মস্থলের একাধিক সূত্রের সাথে যোগাযোগ করে সেখানে তার উপস্থিতির কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার এক কর্মকর্তা জানান, দস্তগীর নামের কেউ এখানে যোগদান করেন নি। সিলেটের প্রভাবশালী সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বসবাস করতেন নগরের শিবগঞ্জের সাইফা সামিট টাওয়ারে। ওই বাসা ছেড়ে গোপনে তিনি সিলেট ছেড়েছেন বলে জানান বাসিন্দারা। তারা জানান- ৫ আগস্টের পর থেকে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে কখনোই প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এমনকি তার পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন আত্মগোপনে। এছাড়া তুরাব হত্যা মামলার আসামী ছাত্রলীগ-যুবলীগ-স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতারা কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আবার কেউ এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিক তুরাব হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাওন মাহমুদ বলেন, আসামী গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এসএমপির কোতোয়ালী মডেল থানার ওসি মোহাম্মদ নুনু মিয়া বলেন, এখন পর্যন্ত তুরাব হত্যা মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এসএমপির পুলিশ কমিশনার মোঃ রেজাউল করিম বলেন, আমি যোগদানের পর থেকে সাংবাদিক তুরাব হত্যা মামলাটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি। একেইতো মার্ডার মামলা, আসামী পুলিশ, তদন্ত করছে পুলিশ। এছাড়া এই ঘটনায় পুলিশও একটি মামলা দায়ের করেছিল। সেটারও তদন্ত চলছে।
তিনি বলেন, দস্তগীর ও আজবাহার সিলেট থেকে বদলী হয়ে গেছেন। নতুন কর্মস্থলে যোগদান না করে থাকলে তারা যে আসামী সেটাই প্রমাণিত হবে। তাদের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত চলছে। তাদের কারো রেহাই হবেনা। পুলিশ সঠিক পথেই এগুচ্ছে। এজন্য সাংবাদিকসহ সকলের সহযোগিতা দরকার।