উত্তপ্ত রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি, আইএসপিআর’র সতর্কতা
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২:২০:০১ অপরাহ্ন
* খাগড়াছড়িতে ৩ ও রাঙ্গামাটিতে ১ মৃত্যু, ১৪৪ ধারা * সবাইকে শান্ত থাকার আহবান প্রধান উপদেষ্টার * পরিস্থিতি পরিদর্শনে আজ পাহাড়ে যাচ্ছেন তিন উপদেষ্টা
জালালাবাদ রিপোর্ট : খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে সদরসহ পুরো জেলায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাতের গোলাগুলি ও বিকেলের সংঘর্ষের ঘটনায় ৩ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)। খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষের প্রভাব পড়েছে রাঙামাটি জেলাতেও।
শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত রাঙামাটি সদরে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষের ঘটনায় একজন পাহাড়ি যুবক নিহত ও আহত হয়েছেন দুই পক্ষের ৫৫ জন।
খাগড়াছড়িতে বাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ এবং গুলিতে ৩ পাহাড়ির মৃত্যুর প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে ঢিল ছোড়াকে কেন্দ্র করে রাঙামাটির সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
খাগড়াছড়ির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাঙামাটিতে শুক্রবার সকাল থেকে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ, দোকানপাট ও বাড়িঘরে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে উল্লেখ করে তিন পার্বত্য জেলায় সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার বিকেলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বার্তায় এ আহ্বান জানানো হয়েছে।
বার্তায় বলা হয়েছে, ১৮ সেপ্টেম্বর এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি ও পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলমান হামলা, আক্রমণ ও প্রাণহানির ঘটনায় সরকার গভীরভাবে দুঃখিত ও ব্যথিত। সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে এবং পার্বত্য তিন জেলায় বসবাসকারী জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেখানে শান্তি, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি নিশ্চিতকরণে সরকার বদ্ধপরিকর।
আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়া এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হওয়ার জন্য সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। বার্তায় বলা হয়েছে, আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়া এবং যেকোনো সম্পত্তি ধ্বংস করা দ-নীয় ও গর্হিত অপরাধ। সহিংসতার সঙ্গে সম্পর্কিত সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত আর দায়ী ব্যক্তিদের বিচার নিশ্চিত করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রশাসন সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে দীঘিনালা লারমা স্কয়ার এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ বাধে। বুধবার মোহাম্মদ মামুন (৩০) নামের এক ব্যক্তিকে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগ মারধরের ঘটনার জের ধরে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। আহত মামুন বুধবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার বাসিন্দা।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এ সময় পাহাড়িরা মিছিলে বাধা দেন বলে অভিযোগ। তখন সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাহাড়িরা ঘরবাড়ি ছেড়ে গহিন পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান।
উত্তেজনাকর পরিস্থিতির বর্ণনা দিল আইএসপিআর :
পার্বত্য দুই জেলা খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সংঘর্ষ ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির পূর্বাপর তুলে ধরে একটি বিবরণ দিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। শুক্রবার বিকেলে আইএসপিআর এই বিবরণ দিয়েছে। এতে চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে বলে সতর্ক করে সেখানে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বসাধারণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
ঘটনার বিবরণে আইএসপিআর বলেছে, গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ি জেলা সদরে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল জনগণের পিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামের এক যুবক নিহত হন। পরে সদর থানা-পুলিশ নিহত ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকেলে দীঘিনালা কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় ইউপিডিএফের (মূল) কিছু সন্ত্রাসী মিছিলের ওপর
হামলা করে ও ২০-৩০টি গুলি ছোড়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বোয়ালখালী বাজারের কয়েকটি দোকানে অগ্নিসংযোগ করে।
এই সংঘর্ষ চলাকালে উভয় পক্ষের ৬ জন আহত হলে তাদের চিকিৎসার জন্য দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে সেনাবাহিনীর টহল দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ফায়ার ব্রিগেড ও স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় আগুন নেভায়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি ও আশপাশ এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে ক্রমেই পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজনাকর করে তোলে। দ্রুততার সঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে জরুরি ভার্চ্যুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা ও পানছড়িসহ সব উপজেলায় যৌথভাবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে টহল দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন কমিউনিটি লিডারদের (স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতাদের) সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সব পক্ষকে সহিংস কর্মকা- থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
একই রাতে (১৯ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ি জোনের একটি টহল দল রাত সাড়ে ১০টায় একজন মুমূর্ষু রোগীকে স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে অবস্থানরত উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে বাধা সৃষ্টি করে। একসময় ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের ওপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। ওই গোলাগুলির ঘটনায় তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয় বলে জানা যায়।
একই ঘটনার ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে স্থানীয় উচ্ছৃঙ্খল জনসাধারণ কয়েকজন যুবকের মোটরসাইকেল থামিয়ে তাদের ওপর হামলা ও লাঠিপেটা করে। সেই সঙ্গে উত্তেজিত জনসাধারণ ইউপিডিএফের (মূল) নেতৃত্বে ফায়ার ব্রিগেডের কার্যালয়ে ভাঙচুর করে।
শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে পিসিজেএসএস (পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি) সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ রাঙামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে স্থানীয় জনসাধারণ রাঙামাটি জিমনেসিয়াম এলাকায় সমবেত হয়। এ সময় ৮০০-১০০০ জন উত্তেজিত জনতা একটি মিছিল বের করে বনরূপা এলাকার দিকে অগ্রসর হয় এবং বনরূপা বাজার মসজিদ, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সিএনজি-অটোরিকশা, মোটরসাইকেল এবং বেশ কিছু দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে উভয় পক্ষের বেশ কিছু লোকজন আহত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রাঙামাটি জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে।
উপরিউক্ত ঘটনাসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে বলে আইএসপিআর সতর্ক করেছে। তারা বলেছে, অনতিবিলম্বে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের চলমান উত্তেজনা প্রশমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। যথাযথ তদন্ত কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শনাক্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো যাচ্ছে।
পরিস্থিতি পরিদর্শনে পাহাড়ে যাচ্ছেন তিন উপদেষ্টা :
পাহাড়ের পরিস্থিতি পরিদর্শনে আজ শনিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি পরিদর্শনে যাবে।
শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিনিধিদলে থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা হাসান আরিফ এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ।