এমসি হোস্টেলে গণধর্ষণের ৪ বছর, ম্যানেজড বাদী : স্থবির বিচার কার্যক্রম!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪:২৮:৫৪ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের এক পড়ন্ত বিকালে দক্ষিণ সুরমার এক যুবক তার নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন তারা। এ সময় ৭/৮ জন ছাত্রলীগ নেতা তাদের ঘিরে ধরে। একপর্যায়ে তাদের জোরপূর্বক জিম্মি করে গাড়িতে তুলে কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। স্বামীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে স্ত্রীকে ধর্ষণ করে তারা।
ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের এমন বর্বর জঘন্য কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে উত্তাল হয়ে উঠে সিলেট। প্রতিবাদের ঝড় ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। তখন গণবিক্ষোভের মুখে তাৎক্ষণিকভাবে জড়িতদের গ্রেফতার করে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনী। শুরু হয় বিচারের তোড়জোড়। একটি মানবাধিকার সংগঠনের সার্বিক সহযোগিতায় তখন গতি পেয়েছিল মামলাটি। কিন্তু কিছুদিন পরই ক্ষমতাসীন দলের চাপে বাদী ম্যানেজড হয়ে যাওয়ায় স্থবির হয়ে পড়ে বিচার কার্যক্রম। এমনকি যে মানবাধিকার সংগঠন ও যেসব আইনজীবী তাদের বিচার কার্যে সহযোগিতা করেছিলেন তাদের এড়িয়ে চলা শুরু করেন মামলার বাদী ধর্ষিতা গৃহবধুর স্বামী মাইদুল ইসলাম।
আজ ২৫ সেপ্টেম্বর বহুল আলোচিত মামলার ৪ বছর পুর্ণ হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাদীপক্ষের নিরবতা ও রহস্যমুলক আচরণের কারণে বর্বরোচিত ঘটনার মামলাটির ৪ বছরেও তেমন অগ্রগতি হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নাজমুল ইসলাম সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হওয়ার পর থেকে মামলাটিকে পুরোপুরি স্থবির করে রাখা হয়। এমনকি নাজমুল সদ্য সাবেক সিটি মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর মধ্যস্থতায় মোটা অংকের টাকায় আপোসে মীমাংসার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইতোমধ্যে বাদীকে এক তৃতীয়াংশ টাকা প্রদান করা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানা গেছে।
এদিকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপারে জানতে এবং আপোষ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন মামলার পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার সংগঠন ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’র সিলেট বিভাগীয় প্রতিনিধি সৈয়দ আকরাম আল শাহান। এর প্রেক্ষিতে মামলার বাদী তাকে প্রাণনাশের হুমকী দিয়েছে বলে চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখ শাহপরান থানায় একটি সাধারণ জিডি করেন মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ আকরাম আল শাহান।
তিনি জিডিতে উল্লেখ করেন, দক্ষিণ সুরমাস্থ সিসিকের ৩০নং ওয়ার্ডের জৈনপুর গ্রামের আব্দুল কাদিরের ছেলে বিবাদী মাইদুল ইসলাম গত ১৩/০৯/২০২৪ইং, শুক্রবার রাত ১০টার সময় হোয়াটস অ্যাপ ০১৭৬৭ ৭১৬৭৯৪ নম্বর থেকে বাদী মানবাধিকার কর্মী সৈয়দ আকরাম আল সাহানের হোয়াটসঅ্যাপ নং- ০১৭৪৮ ৯৯০১৪৮ নম্বরে কল দিয়ে নানা প্রকার কথাবার্তার মাধ্যমে ভয়ভীতি প্রদর্শন সহ হুমকী প্রদান করে এবং তার স্ত্রী, সন্তান কে খুন-জখমের মাধ্যমে লাশ গুম করবে ও বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করবে বলে হুমকী দেয়।
উল্লেখ্য যে, বিবাদী মাইদুল ইসলাম চাঞ্চল্যকর এম.সি কলেজ হোস্টেলে ৮ জন ছাত্রলীগকর্মী কর্তৃক গৃহবধূ গণধর্ষণের মামলার বাদী। মাইদুল উক্ত মামলার আসামীদের সাথে যোগসাজশ করে মামলার ব্যাপারে আপোষ করছেন মর্মে ব্যাপক প্রচার আছে। মাইদুল ইসলামের আচরণেও এটা বোধগম্য যে- উক্ত মামলার আসামীদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
চাঞ্চল্যকর ঐ গণধর্ষণ মামলটি বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এডভোকেটগণ সাড়ে ৩ বছর যাবৎ পরিচালনা করে আসছেন। সেই সূত্রে বাদী সৈয়দ আকরাম আল সাহান মামলাটি পরিচালনার সাথে জড়িত আছেন।
আদালত সূত্র জানায়, ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের ৮ নেতাকর্মীকে অভিযুক্ত করে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা ও মহানগর পুলিশের শাহপরান থানার ওসি (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। গণধর্ষণের ঘটনায় সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার ছেলে সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ জাহাঙ্গীর মিয়ার ছেলে শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের মৃত অমলেন্দু লস্কর ওরফে কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির (গাছবাড়ী) সালিক আহমদের ছেলে মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), সিলেট নগরীর গোলাপবাগ আবাসিক এলাকার (বাসা নম্বর-৭৬) মৃত সোনা মিয়ার ছেলে আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল (২৬) ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নটেশ্বর গ্রামের মৃত ফয়জুল ইসলামের ছেলে মিজবাউল ইসলাম রাজনকে (২৭) অভিযুক্ত করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়।
মামলায় ৫২ জনকে সাক্ষী রাখা হয়। ঘটনার মাত্র দুই মাস ৮ দিন পর ১৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি আদালতে জমা দেয়া হয়। এতে আসামি রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুমকে ধর্ষণে সহায়তা করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়। ৮ আসামিই বর্তমানে কারাগারে আছেন। ঘটনার পরে গ্রেফতার ৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেট ওসমানী মেডিক্যালের ওসিসির মাধ্যমে ডিএনএ সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠায় পুলিশ। নমুনা সংগ্রহের প্রায় দুই মাস পর ডিএনএ রিপোর্ট এসে পৌঁছে। ডিএনএ রিপোর্টে ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর ও মাহবুবুর রহমান রনির ডিএনএ ‘ম্যাচিং’ পাওয়া যায়।
বিগত সরকার চায়নি আলোচিত এই ধর্ষণ মামলার বিচার হোক জানিয়ে বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, মামলার এখন পর্যন্ত কোনও অগ্রগতি নেই। বাদীপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে মামলা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়। এখন পর্যন্ত সেটি না হওয়ায় মামলাটির স্থানান্তর প্রক্রিয়া থমকে আছে।
তিনি আরও বলেন- এর মধ্যে উচ্চ আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে সরকারের পক্ষে ‘অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড’ হরিপদ পাল কর্তৃক লিভ টু আপিল করা হয় বলে মামলার বাদিকে নোটিশ করা হয়। নোটিশ গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমরা পাই। এই বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি আদালত।
বাদী ম্যানেজড এর ব্যাপারে অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন- বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মামলার বাদীকে ম্যানেজ করা হয়েছে। বাদীর আচরণেও তেমনটি প্রকাশ পেয়েছে। কারণ আমরা আইনজীবী প্যানেল ন্যায় বিচারের স্বার্থে সাড়ে ৩টি বছর মামলা পরিচালনা করে আসছি। কিন্তু বাদী হঠাৎ করেই গত বছর থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন। নিজ উদ্যোগে ফোন দিলেও বাদী রিসিভ করতে চান না। কথা বললে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন। এতে বাদী ম্যানেজড হওয়ার সন্দেহকে অমুলক মনে করা যায়না।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী মাইদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করতে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি এক পর্যায়ে তিনি তার মোবাইল নাম্বারটি বন্ধ করে দেন। বাধ্য হয়ে তার ওয়াটসআপ নাম্বারে যোগাযোগ করা হয়। রিং হলেও রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, গণধর্ষণ মামলা ছাড়াও ঐ সময় ছাত্রাবাস থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় সাইফুর রহমান ও শাহ মাহবুবুর রহমান রনিকে আসামি করে অস্ত্র আইনে আরেকটি অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। ঘটনার এক মাস ২৭ দিন পর অস্ত্র মামলার অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এদিকে গ্রেফতারের পর আট আসামির সবাই আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। আসামিদের মধ্যে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, মিজবাহুল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল ১৯ বছর বয়সী ওই নারীকে সরাসরি ধর্ষণ করে। রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম ধর্ষণে সহযোগিতা করে। আট আসামির সবাই ছাত্রলীগের টিলাগড় গ্রুপ জেলা সভাপতি নাজমুল ইসলামের সক্রিয় কর্মী ছিল।
এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, এমসি হোস্টেলের এই ঘটনাটি বর্বর ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এর বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হওয়া উচিত। এমন একটি মামলায় বাদী ম্যানেজড হয়ে যাওয়া আমাদের বিচার বিভাগের জন্য এক অশনি সংকেত। এ ব্যাপারে আইনজ্ঞদের এগিয়ে আসা উচিত। আইনীভাবে এই মামলার ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে আইনজীবী ও বিচার প্রক্রিয়ার সাথে জড়িতদের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এমন ঘটনায় অপরাধীরা পার পেয়ে গেলে এই ধরণের জঘন্য কর্মকান্ড আরো বৃদ্ধি পাবে।