ওসমানীনগরের সাদিখালে অবৈধভাবে জাল বসিয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫:৫৯:৩৭ অপরাহ্ন
ওসমানীনগর প্রতিনিধি: যুগ যুগ ধরে আওয়ামীলীগ পরিবারের দখলে রয়েছে ওসমানীনগরের মাছ আহরণের অন্যতম বৃহৎ জলাধার সাদিখাল। দলীয় ও পেশি শক্তি প্রয়োগ করে অবৈধভাবে এ পরিবারটি বিভিন্ন জাতের জাল ধরতে মৎস্যজীবিদের কাছে খালের গুরুত্বপূর্ণ স্থান লিজ প্রদান এবং বড়শি দিয়ে মাছ শিকারীদের কাছে টিকেট বিক্রি করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ সরকার পতনের পর জাল দিয়ে পোনা মাছ নিধন বন্ধ করে মৎস্যজীবি ও সাধারণ মানুষের জন্য মাছ শিকার উন্মুক্ত করে দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন এলাকাবাসী।
জানা যায়, সিলেটের জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে নামমাত্র টোকেন মানি ফি দিয়ে স্থানীয় দু’টি মৎস্যজীবি সমিতির নামে লীজ আনা হয় ওসমানীনগর উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের মিঠা পানির মাছের অন্যতম বৃহৎ জলাধার সাদীখাল। যদিও খালটি দু’টি মৎস্যজীবি সমিতির নামে লীজ আনা হয় কিন্তু পর্দার আড়ালে থেকে মালিকানা ভোগ করেন উপজেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও সাদীপুর ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান কবির উদ্দিন আহমদ এবং জেলা যুবলীগের সভাপতি ও ওসমানীনগর উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান শামীম আহমদ এর ভাই বেদার মিয়া।
নামমাত্র টোকেন মানি ফি দিয়ে সরকারের কাছ থেকে খাল লীজ আনার পর শুরু হয় বেদার মিয়ার মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা আয়ের সোনার ডিম তোলা। তিনি বর্ষা মৌসুমে বেলজাল ধরার জন্য ক্ষুদ্র মৎস্যজীবিদের কাছে খালের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট ইজারা এবং নিজস্ব কিছু সংখ্যক লোক দিয়ে মাছ ধরে বিক্রি করে প্রায় কোটি টাকার বাণিজ্য করেন। বেশি মাছ ধরা পড়ে এমন স্থানে বেলজাল ধরতে হলে অন্তত এক বছর আগে যোগাযোগ করে অগ্রিম টাকা দিয়ে স্থান নির্ধারণ করার সময় অগ্রীমসহ প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা গুণতে পারলেই কেবল মিলে অপেক্ষাকৃত ভাল স্থান। আর শুকনো মৌসুমে বড়শি দিয়ে মাছ শিকারীদের কাছে টিকেট বিক্রি এবং মাছের কৃত্রিম অভয়ারণ্য তৈরী করে মাছ ধরে বিক্রি করে বড় অংকের টাকা আয় করলেও সরকার প্রকৃত রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
টিকেট ছাড়া খালে একটি জাল বা বড়শি ফেলতে পারেননি খাল তীরবর্তী গ্রামসমুহের কিংবা দূর থেকে আসা কোন শৌখিন মাছ শিকারী। প্রতিদিন বেদার মিয়ার লোকজন গলায় বাঁশি ঝুলিয়ে খালের দুই পাড় দিয়ে বড়শি দিয়ে মাছ শিকারীদের কাছ থেকে তুলে নেন টিকেটের হাজার হাজার টাকা।
প্রায় ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সাদীখাল উপজেলার পশ্চিম পৈলনপুর ইউনিয়নের ভল্লবপুর হাওর থেকে শুরু হয়ে মশাদিয়া, মশাখলা, দৌলতপুর, সাদীপুর ইউনিয়নের সাদিপুর, সুন্দিখলা, ভেড়ারচর, রহমতপুর, সম্মানপুর, চাতলপাড় এলাকায় এসে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ কুশিয়ারা নদীর সাথে মিলিত হয়। অপর অংশটি লোম নামক স্থান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাছের অভয়ারন্য খ্যাত বানাইয়া হাওরে মিশেছে। সাদীখালের কিছু অংশ সাদীখাল, কাটার মার খাল, বেড়ি নদী, চাতলপাড় খাল, লোম নামে ডাকা হয়। সমগ্র খালের বিভিন্ন পয়েন্টে বেলজাল, ভরজাল, উতার জাল, কারেন্ট জাল, বস্তা জাল, চায়না ম্যাজিক জাল, উড়াল জাল ও বড়শি দিয়ে মৎস্যজীবিরা মাছ শিকার করে থাকেন। চাতলপাড় এলাকায় ৬ মাসের জন্য একেকটি জাল থেকে প্রায় ৫০ হাজার থেকে আড়াই লক্ষ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়।
স্থানীয় এলু মিয়া ও দুলাল আহমদ বলেন, আমরা নদীর পড়ের বাসিন্দা কিন্তু টিকেট ছাড়া নদীতে একটা বড়শি কিংবা জাল ফেলতে পারিনা। মৎস্যজীবি মিন্টু দাশ, কাজল বিশ্বাস, অরুণ বিশ্বাস, সাহেব আলী, সেলিম মিয়া, সোহান, নাহিদ, আব্দুস শহিদ, জাকির হোসেন, শাহীন, নেপাল দাস, রিয়াজ উদ্দিন, সাহেল, খোকা দাস, অর্পন দাস জানান, সমিতির মাধ্যমে জাল ধরার জন্য ৫০ হাজার থেকে আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে থাকি। এ টাকা বেদার মিয়া ও আমুর আলী নিয়ে থাকেন।
অভিযুক্ত আমুর আলী বলেন, আমি তাদের কাছ থেকে সামান্য মাছ খাওয়ার জন্য আনি। আমি টাকা পয়সার লেনদেন করিনা। বেদার মিয়া বলেন, আমি কোন টাকা নেই না। টাকা নেয় মৎস্যজীবি সমিতি। আমরা আওয়ামীলীগ করি। স্থানীয় মৎস্যজীবিরা আওয়ামীলীগের কর্মী সমর্থক। বিএনপির লোকেরা তাদের বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন করলে মৎস্যজীবিরা তাদের সাথে থাকেনা। আমরা মৎস্যজীবিদের সহায়তা করে থাকি। তাই বিএনপির হিরন মেম্বার আমার বিরুদ্ধে দরখাস্ত করেছে।
অভিযোগকারী সাবেক মেম্বার হিরন আলী বলেন, ১৯৮৭ সালে মাছ ধরার জন্য সাদিখাল উম্মুক্ত করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রভাবশালী পরিবার সাদিখালে জাল ও বড়শি দিয়ে মাছ ধরার জন্য টাকা নিচ্ছে। আমি সাদীখাল অবমুক্ত করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত আবেদন করেছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনুপমা দাস বলেন, এলাকাবাসির কাছ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।