অবহেলা-অব্যবস্থাপনায় সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে সাদাপাথর
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:২০:০৭ অপরাহ্ন
আব্দুল জলিল, কোম্পানীগঞ্জ : বাংলাদেশে যে কয়টি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর। পাহাড় পানি আর পাথরের মিতালিতে মুগ্ধ হতে প্রতিনিয়তই দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসুরা ছুটে আসেন এখানে। তবে আগে থেকে কমতে শুরু করেছে পর্যটকের সংখ্যা। গত ২ বছর আগে যেই পরিমাণ পর্যটক সাদাপাথর ঘুরতে আসত এখন তার অর্ধেক পর্যটক আসছে। পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর অব্যবস্থাপনার কারণেই পর্যটকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সাদাপাথর থেকে।
মাত্র ১ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দিতে গুনতে হয় ৮’শ টাকা। রিজার্ভ সিস্টেমে চালু এই বোটগুলোতে ৮ জনের বেশি যেতে দেওয়া হয় না। ফ্যামেলী নিয়ে যারা ঘুরতে আসেন তারাই পড়েন বেশি বিপাকে। ২ জন হলেও নৌকা রিজার্ভ নিতে হয় ৮’শ টাকায়। তাছাড়া পর্যটন স্পটের আশেপাশে নেই কোন টয়লেট। পর্যটকরা নদীতে গোসল করে কাপড় চেঞ্জ করারও ভালো কোন সুবিধা নেই।
এদিকে, বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের সাথে আসা পাথরে নদীর উৎসমুখ ভরাট হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকেনা সাদাপাথরে। এছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য নেই ট্যুরিস্ট পুলিশ। যার কারণে দিনদিন পর্যটক হারাচ্ছে দেশের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর।
অপরদিকে, সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবসায়ীরাও রয়েছেন অনিরাপদে। প্রতিমাসে তাদের দিতে হয় চাঁদা। চাঁদা না দিলে ব্যবসায়ীদের মারধরও করা হয়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর একজন ব্যবসায়ী দোকানে চাঁদা না দেওয়ায় তাকে মারধর ও গাড়ি ভাংচুর করা হয়। যা নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ব্যবসায়ীরা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
প্রতিবছর সাদাপাথর নৌকাঘাট ও গাড়ি পার্কিং জোন কোটি টাকার উপরে লিজ দেয় উপজেলা প্রশাসন। পর্যটন উন্নয়ন কমিটির ব্যাংক একাউন্টে সেই টাকা জমা হয়। এই ব্যাংক একাউন্টে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকা থাকলেও সেগুলো পর্যটনের উন্নয়নে খরচ করা হচ্ছে না। পর্যটনের মেঘা প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত বাউন্ডারি দেওয়া জায়গাটিও বেদখল হয়ে গেছে। বাউন্ডারি ভেঙ্গে সেখানে পাথর ভাঙ্গার মেশিন বসানো হচ্ছে।
প্রতি বর্ষার পাহাড়ি ঢলে উজান থেকে নেমে আসে পাথর। সেই পাথর বন্ধ করছে নদীর পানি প্রবাহ। শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ প্রায় বন্ধের উপক্রম হয়ে যায়। যার ফলে নৌকা চলাচলেও বিঘ্ন ঘটে। পাথরের উপর দিয়ে প্রবাহমান স্বচ্ছ জলরাশিই সাদাপাথরকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে পর্যটকদের কাছে। কিন্তু প্রায় ১০ বছর থেকে নদীর উৎস মুখের পাথর না সরানোয় দিন দিন নদীর দু’পাশে ভাঙ্গনে সৌন্দর্য্য হারাচ্ছে সাদাপাথর। দু’পাশের ভাঙ্গনে বড় হচ্ছে নদীর পরিধি, বিস্তৃত হয়েছে পানি প্রবাহের পথ। এতে করে শুকনো মৌসুমে যেমন পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় অন্যদিকে বর্ষায় নদীর দু’পাড়ে ভাঙ্গন দেখা দেয়। নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে সাদাপাথরের পাশের বিজিবির পাথর কোয়ারি ক্যাম্প ও মসজিদ। ভাঙ্গন রোধে জিও ব্যাগ দিয়ে বাঁধ দিলেও সেটি টিকছে না। এবারের বর্ষায় পাহাড়ি ঢলে ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে মসজিদের সিঁড়ি। আর একটু ভাঙ্গন দেখা দিলে বিলীন হয়ে যাবে সাদাপাথর মসজিদ। ভাঙ্গন ঠেকাতে পরিকল্পিতভাবে উৎসমুখ খনন করা অপরিহার্য।
সাদাপাথরে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা হচ্ছে নদীপথ। এক কিলোমিটার নদীপথ যেতে হয় নৌকা দিয়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে সড়ক পথে ভোলাগঞ্জ ১০নম্বর পর্যটন বাজারে এসে নামতে হয়। সেখান থেকে নৌকা রিজার্ভ করে যেতে হয় সাদাপাথর। ১ জন হোন কিংবা ৮ জন নৌকা রিজার্ভ করতে হবে। যাওয়া আসার ৮’শ টাকা দিলে রিজার্ভ মিলে একটি বোট। বোট রিজার্ভ করতে হয় বলে অনেক পর্যটক স্পটে যেতে পারে না। লোকাল পদ্ধতিতে যদি নৌকা চলাচল করত তাহলে সাদাপাথরে পর্যটকদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেত। অনেকেই সিঙ্গেল ট্যুরে আগ্রহী হতো।
এদিকে, দেশের জনপ্রিয় এই পর্যটন কেন্দ্রে নেই টয়লেট ওয়াশরুম কিংবা ভেজা কাপড় পরিবর্তনের জন্য চেঞ্জিং রুম। নাই খাবার পানির জন্য কোন টিউবওয়েল। গত ৩ বছর আগে সাদাপাথরে একটি টয়লেট ও ওয়াশরুম করা হয়েছিল যা পাহাড়ি ঢলের ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। তাছাড়া ২টি ভাসমান টয়লেট ও ৩টি কাপড় পরিবর্তনের জন্য চেঞ্জিং রুম স্থাপন করা হয়েছিল সেগুলোও আর নেই। পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় পর্যটন স্পটে টয়লেট না থাকায়। ১০নম্বর পর্যটন বাজার ছাড়া পর্যটন স্পটে কোন টয়লেট নাই। পর্যটন বাজার থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে সাদাপাথর স্পট হওয়ায় টয়লেটের জন্য চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় পর্যটকদের।
দেশের জনপ্রিয় এই পর্যটন কেন্দ্রে নেই ট্যুরিস্ট পুলিশ। প্রতি বছর কয়ে লক্ষ পর্যটক আসেন সাদাপাথর ভ্রমণে। শুধু দুই ঈদ আর দুর্গাপূজায় প্রায় ১৫-২০ লক্ষ পর্যটক আসেন সাদাপাথর দেখতে। এত পর্যটকের আগমন হলেও সেখানে নেই ট্যুরিস্ট পুলিশের কোন ক্যাম্প। পর্যটন কেন্দ্রে ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তার জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২জন আনসার দেওয়া হয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, সাদাপাথরে আমাদের একটি টিম কাজ করে। সার্বক্ষণিক ভিআইপি প্রটোকল দিয়ে থাকে আমাদের পুলিশ। এছাড়াও নিরাপত্তার জন্য সব সময় আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদা সুলতানা জানান, সাদাপাথরে আগত পর্যটকদের সুবিধার জন্য সেখানে অস্থায়ী টয়লেট স্থাপন করা হচ্ছে। পর্যটন কেন্দ্রের দু’পাশ ভাঙ্গন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড পদক্ষেপ নিচ্ছে।
ট্যুরিস্ট পুলিশের সিলেট জোনের এসপি বেলাল আহমদ জানান, সাদাপাথরে আমাদের একটি ক্যাম্প স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। জনবল সংকটে আমরা সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছিনা। সাদাপাথরে ক্যাম্প স্থাপনের জন্য আমরা গতবছর একটি জায়গা নির্ধারণ করেছিলাম। কিন্তু নোম্যান্সল্যান্ডের মধ্যে পড়ায় সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়নি।