কাশ্মীরের নির্বাচনে বিপুল সাড়া, দিল্লী থেকে চাবি ফেরানোর লড়াই
প্রকাশিত হয়েছে : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯:৫৪:৪৮ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : মাসচারেক আগে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে যখন লোকসভা নির্বাচন হয়, তখনই বোঝা যাচ্ছিল ওখানে কিছু একটা বড়সড় পরিবর্তন অবশ্যই ঘটছে! কারণ যে কাশ্মীর একদা ‘ভোট বয়কট’ আর ‘সেনা জবরদস্তি’র জন্য পরিচিত ছিল, সেখানে মে মাসে গোটা রাজ্যেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোট পড়ে প্রায় ৫৯ শতাংশের কাছাকাছি! ভোটে সেই অকল্পনীয় সাড়া মেলার পর এখন সেপ্টেম্বরে এসে বিধানসভা নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, প্রথম দফায় ভোট পড়ার হার প্রায় ৬২ শতাংশে পৌঁছে গেছে-বিগত প্রায় চল্লিশ বছরের মধ্যে যে জিনিস কখনও ঘটেনি।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর প্রথম দফার ভোটের পরই রাজ্যের প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা পি কে পোলে জানান, কাশ্মীরে লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচন মিলিয়ে গত সাতটা ভোটের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে এই হিসেব। আর বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণেও অভাবনীয় সাড়া মিলেছে, প্রাথমিক হিসেবে সে দিনও ভোট পড়েছে ৫৬ শতাংশর বেশি।
এর মধ্যে জম্মুর মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা কিশতওয়ারে ভোটদানের হার তো ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। জম্মুর রামবান জেলায় ৭০ শতাংশ বা কাশ্মীরের কুলগামেও ৬৫ শতাংশ ভোটার পোলিং বুথে এসেছেন- আর সর্বত্রই ভোট হয়েছে রীতিমতো উৎসবমুখর পরিবেশে।অথচ এই কাশ্মীরেই মাত্র কিছুকাল আগেও নির্বাচন মানেই ছিল হুরিয়ত কনফারেন্স বা বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদীর গোষ্ঠীর ভোট বয়কটের ডাক। ভোট দিতে গেলে জঙ্গী হামলার মুখে পড়তে হবে, ছিল এই আতঙ্কের চোরা স্রোতও।
আর পাশাপাশি অভিযোগ উঠত, বয়কটের ডাক ব্যর্থ করতে ভারতীয় সেনাবাহিনী জোর করে এক-আধটা আস্ত গ্রামকে বন্দুকের মুখে পোলিং বুথে নিয়ে গেছে – যাতে অন্তত এই ছবিটা তুলে ধরা যায় যে কাশ্মীরে ভোট দিতেও মানুষের লাইন পড়ছে!
কিন্তু আজ জম্মু ও কাশ্মীরের ভোটাররা যে স্বত:স্ফূর্তভাবে ভোট দিতে আসছেন, তাতে কোনও সংশয় নেই। চেনা-অচেনা কোনও গোষ্ঠীই ভোট বয়কটের ডাক দেয়নি, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও জোর খাটানোর কোনও অভিযোগ ওঠেনি।
তবে যে কোনও ‘সাফল্যে’র যেমন একাধিক দাবিদার থাকে- তেমনি কাশ্মীরের এই নাটকীয় পটপরিবর্তনের নেপথ্যে কী, তা নিয়েও অনেকগুলো মতবাদ আছে।ভারতের শাসক দল বিজেপি যেমন পরিষ্কার বলছে, পাঁচ বছর আগে ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে তারাই কাশ্মীরকে দেশের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনেছে এবং সে কারণেই গোটা অঞ্চলে এখন শান্তি ও সুস্থিরতা বিরাজ করছে। ব্যালট বাক্সে কাশ্মীরিদের সেই আস্থারই প্রতিফলন ঘটছে বলে তাদের দাবি।
শ্রীনগর ও তার আশেপাশে গত সপ্তাহে বহু সাধারণ কাশ্মীরি বলছেন হ্যাঁ, পরিস্থিতির বেশ অনেকটা উন্নতি হয়েছে এতে কোনও ভুল নেই! কিন্তু বিজেপির এতে কোনও কৃতিত্ব নেই! বছরের পর বছর ধরে টানা অস্থিরতা আর সহিংসতায় ক্লান্ত হয়ে কাশ্মীরের আমজনতাই এবার স্থির করেছে, ঢের হয়েছে, আমরা নিজেরাই উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনব আর ভোট দিতে যাব, বলছেন তারা।
কাশ্মীরে ন্যাশনাল কনফারেন্স বা পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মতো পুরনো ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো আবার বিশ্বাস করে ৩৭০ ধারা এখনও ফিরিয়ে আনা সম্ভব-আর বিপুল সংখ্যায় ভোট দিয়ে উপত্যকার মানুষ বিজেপির সেই চরম বিতর্কিত পদক্ষেপের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
কাশ্মীরে এখনও ‘নিষিদ্ধ’ জামায়াত-ই-ইসলামীর নেতারা পর্যন্ত বলছেন, মানুষের হাতে আর কোনও প্রতিবাদের পথ নেই বলেই তারা বাধ্য হয়ে ভোট দিচ্ছেন-যাতে কাশ্মীরিদের কন্ঠস্বর দিল্লির কানে পৌঁছয়!
আসল কারণ হয়তো এগুলো সব মিলিয়েই-তবে বাস্তবতা হল ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করার পদক্ষেপের সঙ্গে এই প্রতিটি ফ্যাক্টরেরই কিছু না কিছু সম্পর্ক আছে। জম্মু ও কাশ্মীর যে আজ ভোটের লাইনে এসে দাঁড়াচ্ছে, তার পেছনে সেই সিদ্ধান্তের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা অবশ্যই আছে।
বিশেষ স্বীকৃতি বিলোপের পর গত পাঁচ বছরে কাশ্মীরের ‘গ্রাউন্ড রিয়েলিটি’তে ঠিক কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, এই প্রতিবেদন আসলে তারই একটা সরেজমিন অন্তর্তদন্ত।
পর্যটকের ঢল, ফুরফুরে আমেজ :
পাঁচ বছর আগের সেই অগাস্টে গোটা শহরে জারি ছিল কঠোর কারফিউ, রাস্তায় ছিল অবিরত ফৌজি টহল। শ্রীনগরে ডাল লেকের ধারে শিকারা আর হাউসবোটগুলো তখন যথারীতি খদ্দের পায়নি মাসের পর মাস।আর সেই শ্রীনগরেই এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে রোজ প্রায় চল্লিশটা ফ্লাইট নামছে, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের সামলে কূল করতে পারছেন না ট্যাক্সি-চালক, শিকারাওলা বা হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিকরা।
গত বছরের হিসেব বলছে, প্রায় সত্তর বছরের রেকর্ড ভেঙে শুধু কাশ্মীর ভ্যালিতেই ২৭ লক্ষরও বেশি পর্যটক এসেছেন। এদের মধ্যে যেমন ভারতীয়রা আছেন, তেমনি অনেকেই এসেছেন বিলেত-আমেরিকা বা বাংলাদেশ থেকেও।কেন্দ্রীয় সরকারের স্মার্ট সিটি প্রকল্পে শ্রীনগর শহরেরও ভোল ফিরেছে, ঝকঝকে রাস্তায় ছুটছে বিদ্যুৎচালিত আধুনিক বাস আর অটো।
৩৭০-পরবর্তী নির্বাচনি রাজনীতি :
পাঁচ বছর আগে ৩৭০ ধারার বিলোপ জ্ম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ স্বীকৃতিই শুধু কেড়ে নেয়নি, এই অঞ্চলটিকে তা ভারতের একটি পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের বদলে নামিয়ে এনেছিল ‘কেন্দ্রশাসিত’ অঞ্চলের মর্যাদাতেও।যার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার নিযুক্ত একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরই এখন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রশাসক বা দন্ডমুন্ডের কর্তা, বর্তমানে যে পদে রয়েছেন সাবেক বিজেপি রাজনীতিবিদ মনোজ সিনহা।
সাধারণ কাশ্মীরিরা অনেকেই মনে করেন, ব্রিটিশ আমলে যেমন লন্ডনের নিয়োগ করা ‘ভাইসরয়’ বা বড়লাট ভারত শাসন করতেন, এখন দিল্লিও যেন তাদের ভাইসরয়কে দিয়ে কাশ্মীর শাসন করানোর পথ বেছে নিয়েছে। আর এটা তাদের কাছে বড়ই অপমানের!
ফলে এবারের নির্বাচনে কাশ্মীরের পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি প্রায় সব দলের ইশতেহারেই ঠাঁই পেয়েছে। এমন কী বিজেপি পর্যন্ত অঙ্গীকার করেছে, ‘যথাসময়ে’ জম্মু ও কাশ্মীরকে এই মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
শ্রীনগরে ডাল লেকের উত্তর প্রান্তে হজরতবাল আসনে এবার প্রার্থী হয়েছেন স্থানীয় একটি মাজারের প্রভাবশালী পীরসাহেব বিলাল আহমেদ। শানপোরা গ্রামের সরু পথ দিয়ে পীরসাহেব যখন বিশাল কনভয় নিয়ে রোড শো করছেন, তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আপনিও কেন ভোটের লড়াইতে নামলেন? বিলাল আহমেদ জবাব দেন, আসলে কাশ্মীর হল এমন একটা তালা, যার চাবি এখন দিল্লিতে। এই চাবি ফিরিয়ে আনতেই আমরা ভোটে লড়ছি।