ইউপি ছাড়া জনপ্রতিনিধিহীন দেশ
প্রকাশিত হয়েছে : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২:০০:৫৭ অপরাহ্ন
ইউনিয়ন পরিষদও ভেঙে দেয়ার দাবি বিএনপির
জালালাবাদ রিপোর্ট: ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বার ছাড়া দেশে এখন কার্যত আর কোন জনপ্রতিধি নেই। সংসদ সদস্য, সিটি মেয়র, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রদের অপসারণ করা হয়েছিলো আগেই। এরপর কাউন্সিলররা থাকছেন কি না, বিষয়টি স্পষ্ট ছিলোনা। সর্বশেষ অপসারণ করা হলো সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার কাউন্সিলদেরও। বিএনপি দাবি জানিয়েছে, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদেরও অপসারণ করতে হবে।
জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করায় সর্বত্র ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক সেবা। সর্বত্র দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। তবে সরকার বলছে, এটি দেশকে পরিচ্ছন্ন করার প্রচেষ্টা। আগে সব ধরনের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হতো। আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৫ সালে আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। শুরুর দিকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত আংশিকভাবে অংশ নিয়েছিল। তবে সেখানে ব্যাপক কারচুপি, দখলের অভিযোগ ওঠে। পরে ক্রমে বিএনপি-জামায়াত স্থানীয় সরকার নির্বাচন বর্জন শুরু করে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীন কোনো নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ও তাদের নামমাত্র কিছু নামসর্বস্ব দল ছাড়া কেউ অংশ নেয়নি। ফলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ এ বছর অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী দেয়নি। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা কর্মী জয়ী হন। সিটি করপোরেশনের ভোটেও একই চিত্র দেখা গেছে। কার্যত জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রায় সব শীর্ষ পদই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দখলে ছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুথানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। তখন স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশই আত্মগোপনে চলে যান। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল। পরে বিকল্প ব্যবস্থা করে সরকার। যেমন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অনুপস্থিত থাকলে দায়িত্ব পালন করবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। এরপর অধ্যাদেশের মাধ্যমে আইন সংশোধন করে মেয়র-চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগের সুযোগ তৈরি করে সরকার।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছিলেন, এখানে মার মার কাট কাটের কোনো বিষয় নেই। এটি সরকার ও সমগ্র স্থানীয় সরকারকে পরিচ্ছন্ন করার একটি প্রচেষ্টা।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এর বিকল্প কী ছিল? এসব জনপ্রতিনিধি তো অফিসে যাচ্ছিলেন না। তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আমার মনে হয় ঠিকই আছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার বিএনপি এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, প্রহসনের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করে পতিত সরকারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদ বহাল রেখে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্ভব হবে না। ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিধিদেরও অপসারণ করতে হবে।
সংসদ বিলুপ্ত :
সর্বপ্রথমে গত ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সেদিন বঙ্গভবনের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান , বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছে। নির্বাহী আদেশে এই সংসদ বিলুপ্ত করা হলো। এর আগে ওইদিন বেলা তিনটার মধ্যে সংসদ ভেঙে দেওয়ার আলটিমেটাম দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তা না হলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তাঁরা।
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি-জামায়াতবিহীন একতরফা ‘ডামী’ এ নির্বাচনে জয়লাভ করে টানা চতুর্থবারের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ।
এই সরকারের মেয়াদ ৭ মাস হওয়ার মধ্যেই কোটা সংস্কারকে ঘিরে গড়ে ওঠা তুমুল গণ আন্দোলনের মধ্যে শেখ হাসিনার পতন ঘটে। এর মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয় সংসদ। তাতে সরাসরি আসনের ৩০০ এমপি ও সংরক্ষিত আসনের ৩০টি সংসদ সদস্যের পদ শূন্য হয়।
একদিনে নেই সিটি মেয়র, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানসহ ১৮৭৬ জনপ্রতিনিধি :
সংসদ বিলুপ্তির পর গত ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকারের ১২ সিটি মেয়রসহ ১ হাজার ৮৭৬ জনপ্রতিনিধিকে পদ থেকে অপসারণ করে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের ইতিহাসে একযোগে এতসংখ্যক জনপ্রতিনিধিকে অপসারণের নজির নেই।অপসারণ করা জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ১২ সিটি মেয়র ছাড়াও ৬০ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের ৪৯৩ চেয়ারম্যান ও ৪৯৪ জন ভাইস চেয়ারম্যান-মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং ৩২৩ জন পৌর মেয়র ছিলেন।
অপসারণ করা মেয়র ও চেয়ারম্যানদের জায়গায় সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। ওইদিন স্থানীয় সরকার বিভাগ পৃথক প্রজ্ঞাপনে এসব সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। বলা হয়, বিশেষ পরিস্থিতিতে এসব জনপ্রতিনিধি অপসারণের সুযোগ রেখে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে।
১২টি সিটি করপোরেশনের যেসব মেয়রকে অপসারণ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন সিলেট সিটি মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে আতিকুল ইসলাম, ঢাকা দক্ষিণে শেখ ফজলে নূর তাপস, চট্টগ্রামের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, রাজশাহীতে এ এইচ এম খায়রুজ্জামান, খুলনায় তালুকদার আবদুল খালেক, বরিশালে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াৎ আইভী, ময়মনসিংহে ইকরামুল হক, গাজীপুরে জায়েদা খাতুন, রংপুরে মো. মোস্তাফিজার রহমান ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র তাহসীন বাহার। এর মধ্যে রংপুরের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান জাতীয় পার্টির নেতা। আর গাজীপুরে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত মেয়র জায়েদা খাতুন। বাকি সবাই আওয়ামীলীগের নেতা বা নেতাদের স্বজন।
অপসারণের পর ১২টি সিটি করপোরেশনেই প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ এবং নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে অতিরিক্ত সচিব ও সমমর্যাদার চার কর্মকর্তাকে প্রশাসক করা হয়। এছাড়া সিলেট, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রংপুর, ময়মনসিংহ ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনে বিভাগীয় কমিশনারদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
সর্বশেষ ১২ সিটি ও ৩২৩ পৌরসভার কাউন্সিলর অপসারণ :
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের অপসারণ করেছে সরকার। স্থানীয় সরকার বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। এই ১২ সিটি করপোরেশন হলো সিলেট, ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, রংপুর, গাজীপুর ও ময়মনসিংহ। একই সঙ্গে পৃথক প্রজ্ঞাপনে দেশের ৩২৩টি পৌরসভার কাউন্সিলরদেরও অপসারণ করা হয়েছে। এর আগে ১৯ আগস্ট এসব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়েছিল। তখন ১২টি সিটি করপোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার।
এদিকে ৩টি পার্বত্য জেলা ছাড়া বাকি ৬১টি জেলা পরিষদের সদস্যদেরও অপসারণ করা হয়েছে। এসব জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদেরও অপসারণ করা হয়েছিল। সেগুলোতে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এবার জেলা পরিষদের কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য প্রশাসকের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছে সরকার। পৌরসভাতেও প্রশাসকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগের পৃথক আদেশে দেশের ৪৯৩টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করা হয়েছিল। তাদের জায়গায় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া