মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯:৫৪:২১ অপরাহ্ন
হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত *নিরাপদ স্থানে সরানো হলো খামেনিকে
জালালাবাদ রিপোর্ট: মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। ইসরায়েলের হামলায় হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছে। আর তাঁর নিহতের পরপরই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে দেশের ভেতরে একটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন, শনিবার প্রথমে এ দাবি করে ইহুদিবাদী ইসরায়েল। এরপর হাসান নাসরুল্লাহ এর মৃত্যুর বিষয়টি নিজেই নিশ্চিত করেছে হিজবুল্লাহ। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি এ তথ্য জানায় বলে এএফপির খবরে বলা হয়।
বিবৃতিতে হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়, হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল হাসান নাসরুল্লাহ সংগঠনটির মহান ও অমর শহীদ কমরেডদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন; যাদের তিনি ৩০ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর আগে এক এক্স বার্তায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে লেবাননভিত্তিক শিয়া ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছিল।
রাজধানী বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় শুক্রবার রাতভর বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর কমান্ড সেন্টারে সংগঠনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ ও অন্য নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। এরপরই হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার খবর জানানো হয়।
কে এই হাসান নাসরুল্লাহ :
হাসান নাসরুল্লাহর (৬৪) জন্ম ১৯৬০ সালে। বেড়ে উঠেছেন বৈরুতের পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠের বুর্জ হামুদ এলাকায়। বাবা আবদুল করিম ছিলেন একজন সাধারণ সবজি বিক্রেতা। তাঁর ৯ সন্তানের মধ্যে নাসরুল্লাহ ছিলেন সবার বড়।
১৯৭৫ সালে লেবানন গৃহযুদ্ধের মুখে পড়লে হাসান নাসরুল্লাহ শিয়া মুভমেন্ট ‘আমাল’-এ যোগ দেন। পরে ১৯৮২ সালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে দলটি থেকে বেরিয়ে যান তিনি। ১৯৮৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার কথা জানায় হিজবুল্লাহ। তাতে যোগ দেন হাসান নাসরুল্লাহ।
হিজবুল্লাহ শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে চিহ্নিত করে ‘ইসলামের প্রধান দুই শত্রু’ হিসেবে। সেই সঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে ধ্বংস করার ডাক দেয় তারা। দেশটিকে আখ্যায়িত করে মুসলিমদের ভূমি দখলকারী হিসেবে।
১৯৯২ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহর প্রধান হন নাসরুল্লাহ। এর আগে ইসরায়েলের এক হেলিকপ্টার হামলায় নিহত হন তাঁর পূর্বসূরি আব্বাস আল-মুসাবি। হিজবুল্লাহপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর মুসাবি হত্যার প্রতিশোধ নেওয়া ছিল হাসান নাসরুল্লাহর প্রথম কাজ। সে অনুযায়ী ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে রকেট হামলার নির্দেশ দেন তিনি।
নাসরুল্লাহ লেবাননের দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গেও তাঁর যোদ্ধাদের লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। একপর্যায়ে ২০০০ সালে সেখান থেকে পিছু হটে দেশে ফিরে যান ইসরায়েলি সেনারা। তবে নাসরুল্লাহর ব্যক্তিগত ক্ষতিও কম হয়নি। ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রাণ দিতে হয় তাঁর বড় ছেলে হাদিকে।নাসরুল্লাহর নেতৃত্বে হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের যোদ্ধাদের পাশাপাশি ইরাক ও ইয়েমেনের মিলিশিয়াদের প্রশিক্ষণগত সহায়তা দিয়েছে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহারের লক্ষ্যে ইরানের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেটের এক সমৃদ্ধ ভান্ডার রয়েছে হিজবুল্লাহর।
দখলকৃত লেবাননি ভূখ- থেকে ইসরায়েলি সেনাদের তাড়াতে প্রথমে একটি মিলিশিয়া দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল হিজবুল্লাহ। পরে এ দলকেই লেবাননের সেনাবাহিনীর চেয়ে শক্তিশালী এক বাহিনীতে রূপ দেন নাসরুল্লাহ। সংগঠনটি এখন দেশের রাজনীতিতেও উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তারকারী একটি শক্তি।সর্বশেষ হিজবুল্লাহ-ইসরায়েল উত্তেজনা বেড়ে যায় গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে। ওই দিন ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের রকেট হামলার জের ধরে গাজায় নজিরবিহীন তা-ব শুরু করে দেশটি। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রদর্শনের অংশ হিসেবে মাঝেমধ্যেই ইসরায়েলের অভ্যন্তর ও দখলকৃত গোলান মালভূমি এলাকায় রকেট হামলা চালাচ্ছে হিজবুল্লাহ।
খামেনিকে সরিয়ে নেওয়া হলো নিরাপদ স্থানে :
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে দেশের ভেতরে একটি নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে-এমন খবর জানার পরই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তেহরানের সর্বশেষ খবর সম্পর্কে অবগত দুজন আঞ্চলিক কর্মকর্তা রয়টার্সকে এ তথ্য জানিয়েছেন। সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইসরায়েলের হাতে হিজবুল্লাহর প্রধান নিহত হয়েছেন-এমন খবর জানার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে ইরান হিজবুল্লাহ ও ওই অঞ্চলটিতে সক্রিয় অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর (ইরানের সহায়তাপুষ্ট) সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ‘আঞ্চলিক সব প্রতিরোধী শক্তি’ হিজবুল্লাহর পাশে রয়েছে। লেবাননের শিয়া ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ ইসরায়েলি হামলায় নিহত হয়েছেন এমন খবর জানার পর তিনি এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
এদিকে, লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলের মধ্যে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ এবং খামেনিকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়ার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। দুই দশক ধরে ফিলিস্তিনে আগ্রাসনের কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হিজবুল্লাহ। তবে গত ১৬ সেপ্টেম্বর লেবাননে রাজধানীসহ বিভিন্ন অঞ্চলে একযোগে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনায় দুপক্ষের তিক্ততা চরমে পৌঁছায়।
এদিকে, লেবানন ও গাজায় ইসরায়েলের রক্তক্ষয়ী হামলার নিন্দা জানিয়ে শুক্রবার ইরান ও ইয়েমেনে হাজারো মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ইরনার খবরে বলা হয়, লেবাননে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহর প্রতি সমর্থন এবং ‘ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্রের বর্বরোচিত হামলার নিন্দা জানাতে’ কর্তৃপক্ষ আহ্বান জানায়। এতে সাড়া দিয়ে রাজধানী তেহরানসহ দেশটির অন্যান্য শহরে বিক্ষোভ করেছেন হাজারো মানুষ।
এএফপির একজন সাংবাদিক জানান, তেহরানে শুক্রবার জুমার নামাজের পর নগরকেন্দ্রের ইনঘেলাব স্কয়ার ঘিরে বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীদের হাতে হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নাসরুল্লাহর ছবি এবং ফিলিস্তিনি ও হিজবুল্লাহর পতাকা ছিল। তাঁরা ‘ইসরায়েলের ধ্বংস, লেবাননের বিজয়’ বলে স্লোগান দেন। লেবাননে যে ‘রক্তগঙ্গা বইছে’ তার তীব্র নিন্দাও জানান তাঁরা। পোড়ান ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে তেহরান ছাড়াও সেমনান, কোম, কাশান, কেরমানশাহ, সিরাজ এবং বন্দর আব্বাস নগরে বিক্ষোভ হওয়ার খবর এবং ভিডিও ফুটেজ প্রচার করা হয়েছে। ইরান ও ইয়েমেন ছাড়াও বাহরাইনে বিক্ষোভের খবর পাওয়া গেছে। বাহরাইন ইসরায়েলের মিত্রদেশ। দেশটির সরকার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শক্ত হাতে দমন করেছে। লেবাননের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, লেবাননে ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ৮০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।