দেড় টাকার জলবিদ্যুৎ নেপাল থেকে ৮.১৭ টাকায় আমদানি!
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ২:০৮:২৭ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : নেপালের দুটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করতে যাচ্ছে আগামীকাল ৩ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার)।
নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথোরিটি (এনইএ), ভারতের এনটিপিসি বিদ্যুৎ ভ্যাপার নিগম (এনভিভিএন) লিমিটেড এবং বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ত্রিপক্ষীয় এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবে।
এ লক্ষ্যে দুদিন আগেই নেপালের কাঠমান্ডুর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিপিডিবির প্রতিনিধিদল। চুক্তির শর্ত অনুসারে, এনইএ প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পাবে ৬ দশমিক ৪০ মার্কিন সেন্ট বা ৭ টাকা ৬৮ পয়সা (১ ডলার = ১২০ টাকা)। তবে ডলারের বিনিময় হার যত বাড়বে বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় তত বৃদ্ধি পাবে। নেপাল থেকে বাংলাদেশে এই বিদ্যুৎ সরবরাহে ভারতের ভূখণ্ড ও সরবরাহ লাইন ব্যবহার করা হবে। এজন্য ভারতীয় পক্ষও এই চুক্তিতে অংশ নিচ্ছে।
যদিও এ বিদ্যুৎ আনতে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে নেপালের সীমান্ত পর্যন্ত ভারতের ভূখণ্ডে মাত্র ২৬ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের অনুমতি চেয়েছিল বিপিডিবি। সাসেক (সাউথ এশিয়ান সাবরিজিওনাল ইকোনমিক কোঅপারেশন) করিডোরের আওতায় এ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। তবে ভারত সে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। তাই বাধ্য হয়ে ভারতের সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করতে হবে। তাই সঞ্চালন লাইন বাবদ চার্জ দিতে হবে।
এর বাইরে ভারতকে ট্রেডিং মার্জিন হিসেবে দিতে হবে ইউনিটপ্রতি দশমিক শূন্য ৫৯৫ রুপি। সব মিলিয়ে নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রতি ইউনিটের দাম পড়বে প্রায় সোয়া আট টাকা। যদিও দেশে কাপ্তাইয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হয় গড়ে দেড় থেকে দুই টাকা। অর্থাৎ নেপাল থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচগুণ দামে বিদ্যুৎ আমদানি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে নেপাল থেকে বছরে মাত্র পাঁচ মাস বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
সূত্র জানায়, গত ২৮ জুলাই এ চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে চুক্তি স্বাক্ষরটি স্থগিত করা হয়। এ প্রসঙ্গে সোমবার কাঠমান্ডু পোস্টকে নেপালের জ্বালানি, পানিসম্পদ ও সেচ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র চিরঞ্জীবী চটাউত বলেন, চুক্তির সব প্রস্তুতি শেষ করতে মঙ্গল ও বুধবার কাঠমান্ডুতে জ্বালানি সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
তিনি আরও বলেন, এনইএ প্রতি বছর ১৫ জুন থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রির পরিকল্পনা করছে। প্রত্যাশিত রপ্তানির পরিমাণ এক লাখ ৪৪ হাজার মেগাওয়াট ঘণ্টা। এনইএ এই পাঁচ মাসে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি থেকে ৯ দশমিক ২১৬ মিলিয়ন ডলার আয়ের অনুমান করেছে। এজন্য ভারতের মুজাফফরপুরের মিটারিং পয়েন্টসহ ধলকেবর-মুজাফফরপুর ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে নেপালের বিদ্যুৎ রপ্তানি করা হবে। ধলকেবার থেকে মুজাফফরপুর পর্যন্ত ট্রান্সমিশন লাইনে কোনো প্রযুক্তিগত ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ বা মেরামতের খরচ এনইএ বহন করবে।
প্রসঙ্গত, নেপালের বিদ্যুৎ বেহারামপুর (ভারত) থেকে ভেড়ামারা (বাংলাদেশ) পর্যন্ত ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে পৌঁছাবে। এনইএ ২৫ মেগাওয়াটের ত্রিশূলি প্রকল্প এবং ২২ মেগাওয়াটের চিলিম প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে রপ্তানি করবে। তবে এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে নেপালের তেমন কোন ব্যয় নেই। তাই প্রায় বিনা পয়সায় উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের কাছে উচ্চ দামে বিক্রি করছে দেশটি।
এর আগে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার অর্থনৈতিক বিষয়ক কমিটি (একনেক) গত বছর ৬ ডিসেম্বর নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির জন্য নীতিগত অনুমোদন দেয়। পরবর্তীকালে নেপাল, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে বিপিডিবি চলতি বছরের ১ জানুয়ারি পাঁচ বছরের জন্য বিদ্যুৎ কেনার জন্য একটি দরপত্র জারি করে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এনইএর একটি দল বিপিডিবির দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে। নেপাল প্রাথমিকভাবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য ৬ দশমিক ৭০ মার্কিন ডলার প্রস্তাব করেছিল। নেপাল ভারতকে ধার্যকৃত মূল্যের চেয়ে কম দাম বাংলাদেশকে না দেয়ার বিষয়ে জোর দিলে ওই সময় চুক্তিটি হয়নি। পরে সিঙ্গাপুরে বিশ্বব্যাংক আয়োজিত সার্ক এনার্জি সেক্রেটারি পর্যায়ের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৪০ ডলার দাম দিতে সম্মত হয়।
দামের বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানো হলেও বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট কমিটি অনেক পরে গত ১১ জুন আমদানিমূল্য অনুমোদন করে। জমা দেয়া দরপত্রের নথি মূল্যায়ন করার পর বিপিডিবি ৭ জুলাই এনইএকে দরপত্র গ্রহণের অভিপ্রায়ের কথা জানায়। এনইএ দরপত্রের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে এবং অবিলম্বে বিপিডিবি থেকে বিদ্যুৎ বিক্রয় চুক্তির খসড়া গ্রহণ করে। এনইএ তারপর চুক্তির তারিখ নির্ধারণ করে এবং বিপিডিবিকে গত ১০ জুলাই আমন্ত্রণ জানায়।
যদিও বাংলাদেশে চলমান আন্দোলনের কারণে চুক্তিটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আশ্বস্ত করেন, নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি অব্যাহত থাকবে।
বিপিবিডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, মাত্র ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশের চাহিদার তুলনায় কিছুই নয়। ৪০০ মেগাওয়াটের জন্য চুক্তি করা হলেও বিষয়টি গ্রহণযোগ্য মনে হতো। তার ওপর নেপালের ফেলে দেয়া পানিতে এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেড় টাকার বেশি খরচ হবে না। অথচ উচ্চ দামে এ বিদ্যুৎ কেনা হচ্ছে। এ ছাড়া ভারতকে সঞ্চালন চার্জ ও ট্রেড মার্জিন দিতে হবে। এগুলো মূলত দেশের ডলারের অপচয়ের উদ্যোগ। সার্বিক দিক বিবেচনায় চুক্তি সই না করে বাতিল করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।