শর্তের বেড়াজালে বাতিল হচ্ছেনা স্বার্থবিরোধী আদানির চুক্তি!
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ৮:৫২:১৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : ডলার সংকটে আদানির বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ। এতে বিল পরিশোধে গত মাসে চিঠি দিয়েছে আদানি। ফলে নতুন করে আলোচনায় আসে আদানির চুক্তিটি। তবে দেশের স্বার্থবিরোধী নানা শর্ত থাকলেও এ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যেতে পারছে না বাংলাদেশ। কারণ চুক্তিতে নানা ধরনের শর্ত রয়েছে, যার বেড়াজালে আটকে আছে পিডিবি। চুক্তি বাতিল করলে উল্টো বিপদে পড়তে হবে বাংলাদেশকেই।
২০১৭ সালের ৫ নভেম্বর আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) চুক্তি সই করেছিল। এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার ওই চুক্তি সইয়ে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা অনুসরণ করা হয়। চুক্তির খসড়া বিদ্যুৎ বিভাগে এলেও তা পিডিবিতে পাঠানো হয়নি। ফলে পিডিবির কর্মকর্তারা চুক্তির বিষয়ে আগে থেকে কিছুই জানতেন না। ২০২২ সালের শেষ দিকে আলোচনায় আসে আদানির চুক্তির বিষয়টি।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি আদানির সঙ্গে চুক্তিটি বাতিল করা যায় কি না তা নিয়ে আলোচনা করা হয়। বৈঠকে জানানো হয়, চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে কোনো এক্সিট ক্লজ (বাতিল করার সুযোগ) রাখা হয়নি। যদি আদানি টানা ৯০ দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখে তবেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিলের আবেদন করা সম্ভব। তা না হলে বিনা কারণে চুক্তি বাতিল করলে ২৫ বছর ধরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে। এর বাইরে বিদ্যুৎ না কিনেও ২৫ বছর ধরে উৎপাদন সক্ষমতার ৩৪ শতাংশ বিল পরিশোধ করতে হবে।
বৈঠকে আরও জানানো হয়, বিনা কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চুক্তি বাতিল করতে গেলে আদানি আদালতের দ্বারস্থ হবে। এতে বাংলাদেশের পরাজয়ের সম্ভাবনা শতভাগ। কারণ চুক্তিটি এমনভাবে করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ দেশের স্বার্থবিরোধী। এছাড়া আদানির বিদ্যুৎ এ মুহূর্তে বন্ধ করলে দেশে ঘাটতি দেখা দেবে, লোডশেডিং বেড়ে যাবে। কারণ বর্তমানে গ্যাস সংকটে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পুরো সক্ষমতায় চালানো সম্ভব হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে আদানির বিদ্যুৎ কেনায় গড়ে প্রতি ইউনিটে ব্যয় হচ্ছে ১৪ থেকে ১৬ টাকা। তবে এ বিদ্যুৎ বন্ধ হলে ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলো চালু করতে হবে। সে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হবে গড়ে ১৮ থেকে ২০ টাকা। এছাড়া ডলার সংকটে নিয়মিত তেল আমদানি করা সম্ভব নাও হতে পারে। তখন বিপদ আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই আদানির চুক্তি বাতিলের পরিবর্তে কয়লার দাম কমানোর বিষয়ে জোর দিচ্ছে পিডিবি।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি আদানির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন পিডিবির কর্মকর্তারা। বৈঠকে আদানির পক্ষ থেকে বলা হয়, ৬৩০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার প্রতি টন কয়লার দাম (গত মাসে) ১২৭ দশমিক ৭২ ডলার। চুক্তির শর্তানুসারে তাই ৪৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লা ব্যবহার করলে দাম দিতে হবে প্রতি টনের জন্য ৯৩ দশমিক ২৫ ডলার। তবে পিডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়া কোল ইনডেক্সে ৪৬০০ কিলোক্যালরি তাপন ক্ষমতার কয়লার প্রতি টনের দাম ৭২ দশমিক ২৪ ডলার। অর্থাৎ আদানি প্রতি টন কয়লার দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি চাচ্ছে।
পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, কয়লার দাম সমন্বয় করতে পারলেই আদানির বিদ্যুৎ আমদানি ব্যয় দুই টাকা হ্রাস পাবে। এতে চুক্তি বাতিল না করলেও প্রতিযোগিতা মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা সম্ভব হবে। এছাড়া আদানি ভারতে যে কর ছাড় পেয়েছে, তা সমন্বয় করতে পারলে ক্যাপাসিটি চার্জও হ্রাস পাবে। কারণ আদানির গড্ডার বিদ্যুৎকেন্দ্রের এলাকাকে ভারত সরকার ‘এসইজেড’ (বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল) ঘোষণা করে ২০১৯ সালে। এতে সব ধরনের শুল্ক-কর ছাড় পাচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
আদানির সঙ্গে সম্পাদিত বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি (পিপিএ) ঘেঁটে দেখা যায়, চুক্তির ১৩.২-এর (সি) ধারায় ক্যাপাসিটি চার্জের কথা বলা হয়েছে। ক্যাপাসিটি চার্জের হার লেখা হয়েছে পিপিএ’র শেষে শিডিউল-৬-এর টেবিল-এতে। পিপিএ’র ১৩.১-এর (ডি) ধারায় শর্ত দেয়া হয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হবে কতগুলো অ্যাজাম্পশনের (শর্ত) ভিত্তিতে, যার একটি কর ও শুল্ক-সংক্রান্ত। আর কর ও শুল্ক ভারতের করহার নীতির ওপর নির্ভরশীল থাকবে। ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, এসইজেড ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আদানি পাওয়ার সব ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য আদানি মোট আটটি দেশ থেকে যন্ত্রপাতি আমদানি করেছে।
যার মধ্যে রয়েছেÑচীন, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও গ্রিস। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ৯৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ যন্ত্রপাতি চীন থেকে আমদানি করে আদানি। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লা আমদানিতে শুল্ক ও সব ধরনের কর ছাড় পেয়েছে আদানি। এছাড়া কোম্পানিটিকে কোনো ধরনের গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স (জিএসটি), সারচার্জ বা অন্য কোনো শুল্ক-কর দিতে হবে না। সূত্রমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ সক্ষমতায় চললে বছরে লাগবে সাত থেকে ৯ মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা। ফলে শুধু কয়লা আমদানিতেই আদানি শুল্ক-কর ছাড় পাচ্ছে ২০০ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে ভারতের রাজ্য সরকার কার্বন নিঃসরণের জন্য প্রতি টন কয়লার ওপর ৪০০ রুপি বা চার দশমিক ৮৮ ডলার কার্বন ট্যাক্স আরোপ করে। এ ট্যাক্সও ছাড় পেয়েছে আদানি। বছরপ্রতি আট মিলিয়ন মেট্রিক টন কয়লা ধরলে বছরে কোম্পানিটি ছাড় পাবে প্রায় ৩৯ দশমিক শূন্য দুই মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে তারা ছাড় পাবে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। ভারতের সংবাদমাধ্যম আরও জানিয়েছে, এসইজেড ঘোষণার ফলে আদানির গড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রথম পাঁচ বছর শতভাগ শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। পরবর্তী পাঁচ বছর তারা পাবে ৫০ শতাংশ শুল্ক ছাড়। তথ্যমতে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যন্ত্রপাতির জন্য আদানির সাড়ে ১২ শতাংশ কাস্টম শুল্ক ও আবগারি শুল্ক, নির্মাণ কাজের জন্য ১৫ শতাংশ সার্ভিস ট্যাক্স, ঝাড়খ-ের বাইরে থেকে পণ্যসামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে দুই শতাংশ কেন্দ্রীয় বিক্রয় শুল্ক, ঠিকাদারের বিলের ৪০ শতাংশের ওপর ১৫ শতাংশ হারে কম্পোজিট ট্যাক্স, সাড়ে পাঁচ শতাংশ ভ্যাট, নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য এক শতাংশ কল্যাণ ট্যাক্স, চার শতাংশ কর্মচুক্তি ট্যাক্স, ঝাড়খ-ের রাজ্য সরকারকে পানির ব্যবহার চার্জ ও আয়কর দেয়ার কথাও ছিল। তবে এসব শুল্ক ও কর মওকুফ পেয়ে গেছে আদানি।
তবে বিদ্যুৎ বিক্রির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে কোনো ছাড় দিচ্ছে না আদানি। প্রসঙ্গত, আদানির কেন্দ্রটির জন্য পিডিবিকে মাসে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হবে ৩৯ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। বিদ্যুৎ না কিনলেও এ অর্থ দিতে হবে। এ হিসাবে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হবে ৪৭৩ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২৫ বছরে এ চার্জ বাবদ ব্যয় হবে প্রায় ১১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতার কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতেই হবে। তা না হলে পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ ছাড়াও জরিমানা দিতে হবে।
এ বিষয়ে চুক্তির ৩.১-এর (বি) ধারায় বলা হয়েছে, পিডিবিকে চুক্তির প্রত্যেক বছর কেন্দ্রটির বিদ্যমান সক্ষমতার কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ বিদ্যুৎ কিনতে হবে, যা ‘মিনিমাম অফটেক কমিটমেন্ট’ হিসেবে বিবেচ্য হবে। যদি বাংলাদেশ তা কিনতে ব্যর্থ হয় তাহলে পিডিবির পক্ষ থেকে আদানি পাওয়ারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এ ক্ষতিপূরণের মধ্যে থাকবে আদানির কয়লার দাম, কয়লা পরিবহন ব্যয়, বন্দরে কয়লা খালাস ব্যয় ও কয়লা হ্যান্ডলিং ব্যয়। এসব কারণে বাধ্য হয়েই চুক্তিটি বহাল রাখতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।