অস্থিতিশীল চালের বাজার
প্রকাশিত হয়েছে : ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৫:২১ অপরাহ্ন
বস্তা প্রতি বেড়েছে ২০০-২৫০ টাকা
জালালাবাদ রিপোর্ট: শুল্ক প্রত্যাহারের পরও ‘সংবেদনশীল পণ্য’ চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত এক মাসের ব্যবধানে চালের দাম বস্তা প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। পাইকারী ও খুচরা বাজারের চিত্র প্রায় একই। শীঘ্রই কোন সুখবর দেখছেন না ব্যবসায়ীরা।
নতুন করে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে সংসার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন অনেকে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণে রাখতে চালের মজুত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে চাল আমদানিতে শুল্ক পুরোপুরি তুলে নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বৃহস্পতিবার এনবিআর এ প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত কার্যকর হলেও বাজারে কোন প্রভাব পড়ছেনা। সিলেটের বাজার ঘুরে এমনই চিত্র দেখা গেলো।
শুক্রবার সিলেটের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত এক মাসের ব্যবধানে খুচরায় প্রতি কেজি চালের দাম ৪ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। নগরের বন্দরবাজার ও রায়নগরের দুটি খুচরা চালের দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সেপ্টেম্বরে পাইজম সিদ্ধ চাল ৫০ কেজির বস্তা প্রতি দাম ছিলো ২৯৫০-৩০০০ টাকা। সেই চাল অক্টোবর শেষে হয়েছে ৩২০০ টাকা। অর্থাৎ ৫৯ টাকা কেজিদরের চাল উঠেছে ৬৫ টাকায়।
একইভাবে মালা আতপ সেপ্টেম্বরে বিক্রি হয় ৬৫ টাকায় কেজি। সেটি এখন ৭০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। ওই দোকানী বলেন, চালের দাম যে মূল জায়গায় বাড়ছে সেটা ক্রেতাদের বুঝানো যাচ্ছেনা। ফলে ক্রেতাদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হচ্ছে তাদেরও। একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, লাইসেন্স ছাড়াই যত্রতত্র অবৈধভাবে ধান ও চাল মজুতে মেতে উঠেছে একটি অসাধুচক্র। একই সঙ্গে বেশ কিছু মিলমালিক কমদামে কেনা ধান দীর্ঘদিন ধরে মজুত রেখেছেন। এতে বাজারে কমেছে ধানের সরবরাহ। যার প্রভাবে সৃষ্ট কৃত্রিম সংকটে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চালের দাম।
গরিব মানুষের খাদ্য ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায় চালের পেছনে। নতুন করে চালের মূল্যবৃদ্ধিতে সংসার সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। নিত্যপণ্য কিনতে আসা শাকিল বলেন, বাজারে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। সবাই সবার মতো করে দেশ চালাতে ব্যস্ত। কিন্তু বিক্রেতারা এখানে পণ্যের দাম বাড়ানোর উৎসব করছে। প্রতিদিন কিছু না কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়ে ক্রেতাকে নাজেহাল করছে। এখন বেশি দামে চালও কিনতে হচ্ছে।
এর মধ্যে উদ্বেগজনক খবর হলো, সাম্প্রতিক অতিবৃষ্টি ও ভারতসহ উজানের দেশগুলো থেকে আসা ঢলে আমনের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উৎপাদনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ৮ লাখ ৩৯ হাজার টন। অথচ আমন চাল উৎপাদনের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সরকারের কাছে দেওয়া একটি প্রতিবেদনে বলেছে, চাল সরকারের জন্য একটি সংবেদনশীল পণ্য। গরিব মানুষের খাদ্য ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায় চালের পেছনে। চালের দাম এমন সময় বাড়ছে, যখন ভোজ্যতেল, চিনি, সবজি, ডিম, মুরগির মাংসসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দাম চড়া।বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, বছরে দেশে চার কোটি টনের মতো চাল উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দেড় কোটি টনের মতো হয় আমনে। সপ্তাহ তিনেক পর থেকে আমন চাল বাজারে আসা শুরু করতে পারে।
খাদ্য অধিদপ্তরও বলছে, তাদের গুদামে এখন চালের মজুত ১০ লাখ টনের নিচে নেমেছে, যা গত ১৫ আগস্ট ছিল প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ টন। সরকারিভাবে বিতরণ বাড়ানোয় মজুত কমছে। যে হারে চাল বরাদ্দের পরিকল্পনা রয়েছে, তাতে আগামী বছরের জুলাই নাগাদ প্রয়োজনের তুলনায় ১১ লাখ টন চালের ঘাটতি হতে পারে। নিরাপত্তা মজুত ও সম্ভাব্য ঘাটতি বিবেচনায় ১০ লাখ টন চাল আমদানি করা দরকার। বেসরকারি খাতকেও চাল আমদানি বাড়াতে উৎসাহ দেওয়া প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সম্প্রতি বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চাল উৎপাদন কম হবে। তাই আমদানি করে দেশের বাজারে চালের সরবরাহ বাড়ানো না গেলে খাদ্যে ঘাটতির শঙ্কা তৈরি হতে পারে। গত আগস্টে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার কারণে আমন চাষে প্রভাব পড়ার পর থেকে খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়তি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৬ আগস্ট থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে দুই দফা বন্যা দেখা দেয়। এতে আট লাখ ৩৯ হাজার টন চালের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
এদিকে, শুল্ক কমানোর পরও বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ব্যবসায়ীরা। তাঁরা বলছেন, চাল আমদানি করা হলে বর্তমান বাজারের চেয়ে বেশি দামে ক্রেতাদের কিনতে হবে। বেশি দামের কারণে দেশের ব্যবসায়ীদেরও মুনাফা হবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, চাল খুবই সংবেদনশীল পণ্য। সরকার চাইলেও অনেক সময় হুট করে আমদানি সম্ভব হয় না। বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে ও কারসাজি ঠেকাতে সরবরাহ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের উচিত এখন দরিদ্র মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে ব্যাপকভাবে চাল সরবরাহের ব্যবস্থা করা। এ জন্য টাকার প্রয়োজন হলে অন্য খাতে খরচ কমাতে হবে। তিনি বলেন, আগামী বোরো মৌসুমে যাতে ধান আবাদ বেশি হয়, সে জন্য এখন থেকেই প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া দরকার। সুনামগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলসহ বোরো প্রধান অঞ্চলগুলোতে এখন থেকেই নেমে পড়তে হবে।