টাস্কফোর্সের অভিযানে জব্দ নৌকা ছেড়ে দিলেন মেম্বার
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ৭:২০:৫১ অপরাহ্ন
আব্দুল জলিল, কোম্পানীগঞ্জ: সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে টাস্কফোর্সের অভিযানে জব্দ নৌকা টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক ওয়ার্ড মেম্বারের বিরুদ্ধে। ৩-৬ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি প্রতিটি নৌকা ছেড়ে দেন বলে জানা গেছে।
গত ২১ অক্টোবর বালু পাথর উত্তোলন বন্ধে ধলাই নদীতে টাস্কফোর্স অভিযান চালায়। রাতভর এ অভিযানে ১৩৬টি নৌকা আটক করা হয়। পরে নৌকাগুলো পূর্ব ইসলামপুর ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার কাজল সিংহ এর জিম্মায় রাখা হয়।
সাদাপাথর চুরি ও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে উপজেলা প্রশাসন পুলিশ ও বিজিবির সমন্বয়ে ধলাই নদীতে টাস্কফোর্সের অভিযান পরিচালিত হয়। এ সময় ভোলাগঞ্জ আদর্শগ্রাম, কালিবাড়ী ও কলাবাড়ীর আশপাশে নদীতে থাকা ১৩৬টি কাঠের নৌকা ধরে নিয়ে আসা হয়। এদিন এই নৌকাগুলো কাজল মেম্বারের জিম্মায় দেওয়া হয়েছিল। পরে ১৩৬টি নৌকা জব্দ দেখিয়ে উপজেলা ভূমি অফিসের সুকুমার নম বাদী হয়ে কোম্পানীগঞ্জ থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর থেকে কাজল মেম্বার নৌকার মালিকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নৌকা ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
টাস্কফোর্সের অভিযানে আটক নৌকা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে সেই ওয়ার্ড মেম্বার কাজল সিংহ এর একটি রেকর্ড এই প্রতিবেদকের হাতে আসে। এতে কাজল মেম্বারকে বলতে শুনা যায়, ‘কয়েকটি নৌকা আমি টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছি এটা সঠিক। তারা উপকার পেয়েছে তাই টাকা দিয়েছে। আছিয়া খাতুনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি কিন্তু তার নৌকা আমি দিব না। সে বাজারে সবার সামনে আমাকে কেন টাকা দিল। তাছাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আপ্তাব আলী কালা মিয়ার রিকোয়েস্টে ৩টি নৌকা ছেড়েছি। এক দলের মানুষ আমরা রিকোয়েস্ট করলে তো রাখতে হয়। আমি সবাইকে বলে দিয়েছি তোমরা চুরি করে নৌকা নিয়ে যাও। তারা চুরি করে নিয়ে গেলে আমার উপর প্রেসার আসার সুযোগ নাই। আমার ওয়ার্ডের সবার নৌকা দিয়ে দিছি কয়েকটা বাদে। তাদের নাম ও আইডি কার্ড রেখে দিয়েছি যাতে কোন সময় প্রয়োজন হলে তাদের কাছ থেকে নৌকা আনতে পারি। আমি কৌশলে সব এড়িয়ে যাচ্ছি। কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি বলি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে সব নৌকা। আমার উপর যাতে দোষ না আসে সেজন্য একজন পাহারাদারও আমি রাখছি। এখন নৌকা যাই থাক কাগজে তো ১৩৬টা আছে। আমি মামলার আইওকে ম্যানেজ করে সেগুলো অকশন দিয়ে নিয়ে আসবো।’
নৌকার পাহারায় থাকা মনফর আলী শুক্রবার রাতে কাজল মেম্বারের মাধ্যমে নৌকা ছেড়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা নিয়ে নৌকাগুলো ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন মাত্র ৭০টি নৌকা রয়েছে।
কালিবাড়ী গ্রামের নুর উদ্দীন বলেন, টাস্কফোর্সের অভিযানে আমার নৌকা আটক করা হয়েছিল। পরে মেম্বারের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা দিয়ে আমি নৌকা ছাড়িয়ে এনেছি। রাধানগর গ্রামের আব্দুল জলিল বলেন, কাজল মেম্বারকে ৪ হাজার টাকা দিয়ে আমি নৌকা ছাড়িয়ে এনেছি। তাছাড়া যে যত টাকা দিয়ে মেম্বারকে ম্যানেজ করতে পারছে তা দিয়ে নৌকা ছাড়িয়ে আনছে। আহমাদাবাদ গ্রামের এরশাদ মিয়া জানান, আমার দুটি নৌকা নেওয়া হয়েছিল। একটি নৌকা ৫ হাজার টাকা দিয়ে এনেছি। অন্যটি এখনও দেয়নি। মেম্বার বলছেন এখন আর দেওয়া সম্ভব না মামলা রেকর্ড করা হয়ে গেছে।
বারকি শ্রমিক মুজিবুর রহমান জানান, কাজল মেম্বার নৌকার আকার ভেদে টাকা নিয়ে নৌকা ছেড়ে দিচ্ছেন। ছোট নৌকা ৩ হাজার, বড় নৌকা ৬ হাজার আর নতুন নৌকা ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছাড়ছেন তিনি। আছিয়া খাতুন নামের একজন জানিয়েছেন নৌকা ছাড়ানোর জন্য তিনি কাজল মেম্বারের হাতে ৪ হাজার টাকা দিয়েছেন। মেম্বার নৌকা ছাড়ার জন্য শুধু তারিখ দিচ্ছেন। নৌকা ছাড়ানোর জন্য তিনি সুদের মাধ্যমে এই টাকা এনে দিয়েছেন বলেও জানান।
অভিযুক্ত ওয়ার্ড মেম্বার কাজল সিংহ বলেন, মুজিব আমার কাছে টাকা দিয়েছে এটা সঠিক। কিন্তু আমি তার নৌকা দেইনি। সে বাজারে আমার কাছে টাকা দিয়েছে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে। তাছাড়া আমি কারো নৌকা ছেড়ে দেইনি। বিজিবি’র পোস্টের সামনে নৌকা রাখা হয়েছে সেখান থেকে আমি চাইলেও নৌকা ছাড়তে পারব না। নৌকা চুরি হওয়ার খবর পেয়ে আমি একজন পাহারাদারও নিয়োগ দিয়েছি, যাতে কেউ নৌকা নিতে না পারে। এখন মাত্র ৮৬টি নৌকা সেখানে রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিজিবি কালাসাদেক বিওপির কোম্পানী কমান্ডার রজব আলী বলেন, নৌকাগুলো আমাদের জিম্মায় রাখা হয়নি। এগুলো দেখার দায়িত্বও আমাদের না। টাস্কফোর্সের অভিযানের পর নৌকাগুলো আমাদের পোস্টের সামনে রাখা হয়েছে। নৌকার দায়িত্বে রয়েছেন কাজল মেম্বার।কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, নৌকা বিজিবি ও মেম্বারের জিম্মায় রাখা হয়েছে। তাছাড়া নৌকা আটকের বিষয়ে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। যাদের জিম্মায় নৌকা রাখা হয়েছে তারা আদালতে বুঝিয়ে দিবেন।
টাস্কফোর্সের অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবিদা সুলতানা বলেন, টাস্কফোর্সের অভিযানে আটক করা নৌকা মেম্বার ছেড়ে দিতে পারেন না। এটি এখন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। টাকা দিয়ে নৌকা ছাড়ার লিখিত অভিযোগ পেলে আমরা আদালতে সে বিষয়টি প্রেরণ করবো।