প্রতিরোধহীন ‘ডেঙ্গু’ ছড়াচ্ছে দ্রুত মৃত্যু বেড়ে ৩১৪, হাসাপাতালে ৬৪,৪৭১
প্রকাশিত হয়েছে : ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১০:৪৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। ১০ জনের মৃত্যুর ২৪ ঘন্টার মাথায় আরো ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। শনিবার সকাল থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত এই রোগে দেশে নতুন করে মারা গেছেন ৪ জন। এই সময়ে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ১৩০৬ জন। এদিকে চলতি মওসুমে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১৪ জনে। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৪৭১ জনে।
জানা গেছে, সময়কাল নেই ডেঙ্গুর। এডিস মশাবাহিত এই রোগটি এখন সময়কাল ছাড়াই ছড়ায়। প্রতিরোধহীন ডেঙ্গু রাজধানী ঢাকার সীমানা ছাড়িয়েছে গত কয়েক মাস আগেই। এখন আক্রান্ত ও রোগীর মৃত্যুর সংখ্যাও দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। সরকার ও তার অধীনস্থ সংস্থাগুলোর পক্ষে জোরালো ও কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতির কারণেই ফি বছর ডেঙ্গুতে প্রাণহানির ঘটনা বাড়ছে। এবছরও সেই ধারার বাইরে নয়।
প্রতিবছরই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য সংশ্লিষ্টদের দায়ী করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা এর দায়িত্বে রয়েছেন তারা এটাকে চাকরি হিসেবে দেখছে, সেবা ও ভালোবাসার আন্তরিকতাপূর্ণ সহাবস্থানের অনুপস্থিতিও ডেঙ্গু পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। একইসাথে রোগীর অসচেতনতা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডেঙ্গু রোগীর যথাযথ চিকিৎসা না করেই অন্য হাসপাতালে রেফার করা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের দুর্বলতা প্রতিবছরই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে এখনও ডেঙ্গু রোগীর উপচে পড়া ভিড়। চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা। স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিদিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে দেখা যায় গত কয়েক মাসের তুলনায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৫৫ শতাংশই ঢাকার বাইরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে সে বিষয়ে আগেই সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এখনও যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তবে, ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গুর ভয়াবহ রূপ শক সিনড্রোম নিয়ে বেশিরভাগ রোগী ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে।
৪ জনের মৃত্যু : গত গত ২৪ ঘন্টায় দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরো ৪ জন। এই সময়ে নতুন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৩০৬ জন। এ নিয়ে চলতি বছরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩১৪ জনে। এদিকে নতুন ১৩০৬ জনকে নিয়ে এ বছর ভর্তি রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪ হাজার ৪৭১ জনে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের জানিয়েছে, হাসপাতালে নতুন ভর্তি হওয়া ১৩০৬ জনের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১১৮ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২১৪ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ২৫৫ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ২৭৭ এবং দক্ষিণ সিটিতে ১৪৪ জন, খুলনা বিভাগে ১৫৪ জন, রাজশাহী বিভাগে ৫৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩১ জন, রংপুর বিভাগে ৪৭ জন এবং সিলেট বিভাগে ৯ জন ভর্তি হয়েছেন। এর একদিন আগে শনিবার এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসময়ে দেশে এ রোগ নিয়ে আরও ৯৬৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
এ বছর ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ পেয়েছে বর্ষা মৌসুমের শেষে এসে। শুধু অক্টোবরেই ৩০ হাজার ৮৭৯ জন এ রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যা সারা বছরের মোট ভর্তি রোগীর অর্ধেক। এর অক্টোবরে ডেঙ্গুতে প্রাণ গেছে ১৩৪ জনের, যা বছরের মোট মৃত্যুর ৪৪ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালে ডেঙ্গু নিয়ে মোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বছর মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে ২৮১ জন মারা যান।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন, তাহলে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীতে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুই সিটি করপোরেশন কী পদক্ষেপ নিয়েছে? গত বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতি মাথায় রেখে এ বছর যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা পরিস্থিতি সামলাতে আসলে কতটুকু ফলপ্রসূ হবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর কোনো দেশেই ডেঙ্গুতে এতো মৃত্যুর রেকর্ড নেই। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন বাংলাদেশে অসচেতনতার কারণে রোগীদের দেরিতে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া। বিশেষত নারীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা কম, জ্বর নিয়ে অবহেলা করে ফলে ডেঙ্গু শনাক্ত হতে দেরি হয়। একইসাথে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক আহমেদ বলেন, প্রথমত রোগীর সংখ্যা বাড়লে আনুপাতিক হারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। দ্বিতীয়ত গত বছর সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে যেসব কারণ সেগুলো কিন্তু দূর হয়নি। “যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থা যেটা আছে আমাদের সেটা বিকেন্দ্রীকরণ হয়নি। এছাড়া যারা শনাক্ত হচ্ছে কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রোগী নয়, তাদেরকে মাঠপর্যায়ে হাসপাতালে রাখার কথা, আবার যারা জটিল রোগী তাদেরও একসাথে রাখা হচ্ছে, ফলে তারা যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না। সব একজায়গায় হওয়ার কারণে ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। যতই ডাক্তার দেন, স্যালাইন দেন, ফ্লোরে রোগী রেখে কি সমাধান করা যায় নাকি? কাজেই চিকিৎসা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা খুব দরকার।”
অনেকক্ষেত্রেই রোগীকে উপজেলা পর্যায়ে প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে জেলা কিংবা বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করা হয়। এতে মধ্যবর্তী সময়ে অনেক রোগী প্লাটিলেট কমে গিয়ে মুমূর্ষু হয়ে যায়। অন্তিম অবস্থায় চিকিৎসা পাওয়া এসব রোগীকে সুস্থ করা কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, “কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সেটি সবাই জানে। কিন্তু প্রতিবারই আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। প্রতিবারই বলছি আমরা কাজ করছি, এটা করছি, সেটা করছি। কিন্তু নাগরিকরা ফলাফল পাচ্ছে না।” এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান ভিত্তিকভাবে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ ঘটাতে হবে বলে মনে করছেন এই কীটতত্ত্ববিদ।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে তিনটি ব্যবস্থার কথা জানান তিনি। এর মধ্যে হটস্পট ম্যানেজমেন্টের আওতায় যেসব বাড়িতে ডেঙ্গু রোগী আছে সেখানে ২০০ মিটারের মধ্যে ক্রাশ কর্মসূচি করতে হবে। উড়ন্ত এডিস মশাগুলো এবং লার্ভা ধ্বংস করতে হবে। ফলে ওই বাড়িতে বা আশেপাশের বাড়িতে কেউ আক্রান্ত হবে না। দ্বিতীয়ত, সারা ঢাকাতেই লার্ভা নিয়ন্ত্রণে লার্ভিসাইডিংয়ের বিষয়টাকে জোর দিতে হবে। তৃতীয়ত, এডিস মশার প্রজনন-স্থল ধ্বংস করতে হবে। তিনি বলেন, “এই তিনটি কাজ যদি এখন জোরেশোরে শুরু করতে পারি তবে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে হবে। আর যদি না পারি তবে আমি স্ট্রংলি বলছি সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।”