ট্রাম্পের অবিস্মরণীয় বিজয়, ১৩২ বছর পর প্রত্যাবর্তনের নজির
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২:০০:৫৪ অপরাহ্ন
* ইলেকটোরাল কলেজ ভোট ট্রাম্প ২৭৯, কমলা ২২৩ * উচ্চকক্ষ-নিম্নকক্ষও রিপাবলিকানের নিয়ন্ত্রণে * বিজয় ভাষণে আমেরিকাকে ফের শ্রেষ্ঠ করার অঙ্গীকার
জালালাবাদ রিপোর্ট: এভাবেও ফিরে আসা যায়! রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের এক অনন্যপ্রায় নজির গড়লেন দু’বছর পরে আশির কোঠায় পা দিতে চলা ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালে হেরে ‘সাদা বাড়িটি’ ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। অবিস্মরণীয় জয়ে চার বছর পর ফের সেই বাড়িতেই প্রবেশাধিকার পেয়ে গেলেন ট্রাম্প। তবে আমেরিকার ইতিহাসে এই ঘটনাকে পুরোপুরি নজিরবিহীন বলা যাবে না। আধুনিক আমেরিকার ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, অতীতে মাত্র এক বারই এক প্রেসিডেন্ট ভোটে পরাজিত হয়েও পরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন। সে অবশ্য ১৩২ বছর আগের ঘটনা। দেড় শতক পরে আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হিসাবে ‘পরাজিত হয়েও বিজয়ী’ হলেন ডোনাল্ড।
ট্রাম্পের আগে আমেরিকায় প্রত্যাবর্তনের নজিরটি যিনি গড়েছিলেন, তাঁর নাম গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড। নিউইয়র্কের এই ডেমোক্র্যাট ১৮৮৪ সালে খুব অল্প ব্যবধানে জয়ী হয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ১৮৮৮ সালে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট (পপুলার ভোট) বেশি পেয়েও হেরে যান তিনি। কিন্তু তার পর রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি তিনি। ১৮৯২ সালে রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী বেঞ্জামিন হ্যারিসনকে হারিয়ে পুনরায় জয়ী হন তিনি। ১৩২ বছর আগে ডেমোক্র্যাট ক্লিভল্যান্ড যে নজির গড়েছিলেন, এ বার সেই একই নজির গড়লেন রিপাবলিকান ট্রাম্প।
ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবনের রেখচিত্র অন্য অনেকের মতো খুব একটা মসৃণ নয়। ব্যবসার চেনা অঙ্গন ছেড়ে রাজনীতির আনকোরা ময়দানে পা রেখেছিলেন তিনি। সঙ্গে ছিল অতীত জীবনের নানা বিতর্ক। তবু সবকিছুকে পেছনে ফেলে উত্থানের পর পতন, তার পর আবার উত্থানের উদাহরণ হয়ে রইলেন সোনালি চুল, নীল স্যুট, লাল টাইয়ের এই রাজনীতিক।
কেবল প্রত্যাবর্তন-ই করলেন না, ক্ষমতাধর আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্ট হয়েই হোয়াইট হাউসের পথ ঠিক করলেন ট্রাম্প। তাঁর বয়স এখন ৭৮ বছর। এর আগে জো বাইডেন ৭৭ বছর বয়সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। শুধু তাই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প হলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি ফৌজদারি অপরাধে দ-িত হয়েছেন।
সাত ‘সুইং স্টেট’-সহ সর্বাধিক প্রদেশে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছেন রিপাবলিকান ট্রাম্প। সুইং স্টেটগুলির ৭টিতেই জয় পেয়েছে রিপাবলিকান পার্টি। গতবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই সাতটির মধ্যে ৬টি নিজেদের দখলে রেখেছিল ডেমোক্রেটিকরা। মার্কিন রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বরাবরই নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে এই ৭ নিরপেক্ষ প্রদেশ। যেগুলি হল, পেনসিলভেনিয়া, উইসকনসিন, মিশিগান, জর্জিয়া, নেভাদা, অ্যারিজোনা ও নর্থ করোলিনা। বলা হয়, এই ৭ প্রদেশ যার দিকে ঝোঁকে আমেরিকার মসনদ যায় তাঁর দখলে।
মঙ্গলবার রাতে ভোট শেষ হওয়ার পর গণনা শুরু হতেই ধাক্কা খায় ডেমোক্র্যাটরা। প্রথম থেকেই পিছিয়ে পড়েন কমলা হ্যারিস। সারা বিশ্বে উত্তেজনার ঢেউ তুলা আমেরিকার নির্বাচনে ইলেকটোরাল কলেজের ম্যাজিক ফিগার ২৭০। আর সেটি অতিক্রম করেছেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প ৬০ বছর বয়সী কমলা হ্যারিসকে হারিয়েছেন। এর আগে ২০১৬ সালে তিনি আরেক নারী প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন।
ডেমোক্র্যাটপ্রার্থী কমলা হ্যারিস বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট। কমলার সঙ্গে ট্রাম্পের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে বলে আগেই ধারণা করা হচ্ছিল। বিশেষ করে দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটের ফলে নজর ছিল সবার। তবে নির্বাচনের ফলাফলে অবশ্য তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।
পাখির চোখ করে সারাবিশ^ যখন আমেরিকার দিকে তাকিয়ে তখনই সর্বশেষ দোদুল্যমান উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে জয় পান ট্রাম্প। ইউসকনসিনে ১০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এ জয়ের ফলে ট্রাম্পের ঝুলিতে জমা পড়ে ২৭৯টি ইলেকটোরাল ভোট, যা আরও বাড়তে পারে। কারণ এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফলাফল পেতে বাকি আরও পাঁচটি অঙ্গরাজ্যের। যেসব অঙ্গরাজ্যের গণনার ফল মেলেনি, তার মধ্যে আছে-নেভাডা (৬), অ্যারিজোনা-১১, আলাস্কা (৩), মিশিগান (১৬), মাইনে (৪)।
অন্যদিকে, কমলার ঝুলিতে জমা পড়ে ২২৩টি ইলেকটোরাল ভোট। আগে থেকে যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের কথা বলছিল বিভিন্ন জরিপ, তা যেন জাদুর শিল্পে উড়িয়ে বিজয়ী হলেন ট্রাম্প। ধারেকাছে ঘেষতে দিলেন না কমলা হ্যারিসকে।
এছাড়া নির্বাচনে শুধু উচ্চকক্ষ সিনেটই নয়, নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভসের নিয়ন্ত্রণও রিপাবলিকানদের হাতে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সিনেটে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পেয়েছে ৫২টি আসন, আর কমলার ডেমোক্রেট পেয়েছে ৪২ আসন। ওদিকে, হাউসে ট্রাম্পের রিপাবলিকান পেয়েছে ২০৪টি আসন ও কমলার ডেমোক্রেট পেয়েছে ১৮২টি সিট। এদিকে, নিজের জয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর বুধবার ফ্লরিডার পাম বিচে প্রথম বিজয়-ভাষণ দিলেন ট্রাম্প। তাঁর বক্তব্যের সিংহভাগ জুড়ে ছিল, আমেরিকাকে বিশ^সভায় ফের শ্রেষ্ঠ করে তোলার আশ্বাস। ট্রাম্পের সঙ্গেই মঞ্চে উঠেছিলেন তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া ট্রাম্প এবং পরিবারের অন্য সদস্যেরা। ছিলেন আমেরিকার সম্ভাব্য হবু ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সও।
মঞ্চে উঠেই ‘বিপুল জয়ের’ জন্য আমেরিকাবাসীকে ধন্যবাদ জানান ট্রাম্প। বলেন, সমালোচকদের ভুল প্রমাণিত করে আমরা জয়ী হতে চলেছি। আমেরিকা অভূতপূর্ব এবং শক্তিশালী রায় দিয়েছে। তার পরেই ফের ‘আমেরিকাকে আবার শ্রেষ্ঠ করব’ স্লোগানটি দেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প যখন ভাষণ দিচ্ছেন, তখন তাঁর সমর্থকেরা একনাগাড়ে ‘আমেরিকা-আমেরিকা’ স্লোগান দিতে থাকেন। ট্রাম্প উদ্বেলিত সেই সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, সব সমস্যার সমাধান করব। আমরা আবার আমেরিকার সোনালি যুগ ফিরিয়ে আনব।
ভোটপ্রচারে আমেরিকায় অনুপ্রবেশ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বারের জন্য হোয়াইট হাউসে ঢোকার আগে বুধবার বিজয়-ভাষণের মঞ্চ থেকেও ট্রাম্প বলেন, আমরা সীমান্ত বন্ধ করব। অনুপ্রবেশ বন্ধ করা হবে।
নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে জানিয়ে খানিক আবেগতাড়িত হয়েই ট্রাম্প বলেন, আমি প্রতিটি দিন আপনার জন্য, আপনার পরিবারের জন্য এবং আপনার ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করব। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমি আপনাদের হয়ে লড়াই করব। নিজের রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য পরিবার, বিশেষত স্ত্রী মেলানিয়াকে ধন্যবাদ জানান ট্রাম্প।
ট্রাম্পের পরে বক্তব্য রাখতে ওঠেন তাঁর ‘রানিং মেট’, হবু ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স। তিনি জানান, এই ধরনের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন প্রায় বিরল। বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, ট্রাম্পের উত্থানের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ অবশ্যই অভিবাসন নীতি। অবৈধভাবে আমেরিকায় বসবাসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে শুরু থেকে সরব ডোনাল্ড ট্রাম্প। অভিযোগ ওঠে বাইডেনের শাসনে আমেরিকায় অনুপ্রবেশ আরও মাত্রাছাড়া আকার নিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারেও বার বার এই ইস্যুতে সরব হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী। ‘সাদা বাড়ি’ দখলের লড়াইয়ে এই নীতিই ট্রাম্পকে এগিয়ে রেখেছিল হ্যারিসের তুলনায়। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে উঠে আসছে বাইডেন শাসনে আমেরিকার দুর্বল অর্থনীতি এবং ট্রাম্পের ‘স্ট্রং ম্যান’ ভাবমূর্তি।
ট্রাম্প তাঁর প্রচারের সুর বেঁধেছিলেন ‘আমেরিকা প্রথম’ এবং ‘আমেরিকাকে ফের শ্রেষ্ঠ করে তোলো’- এই দুই স্লোগানের উপর ভর করে। ২০১৬ এবং ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও জাতীয়তাবাদী এই ভাষ্য এবং স্লোগানের উপর ভর করে প্রচার সেরেছিলেন ট্রাম্প। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।