বন্ধের পথে ‘নগর এক্সপ্রেস’! ৪ বছরে বাস কমে অর্ধেক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩:০৬:০৯ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল:
সিলেট নগরীর যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে ২০১৯ সালে দ্বিতীয় দফায় চালু হয় ‘নগর এক্সপ্রেস’ নামে গণপরিবহন সার্ভিস। এর মাধ্যমে নগরবাসীর জন্য সেবার নতুন মাত্রা যোগ করে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। ২১টি মিি নবাস নিয়ে চালু হয় এই সার্ভিস। কিন্তু ধীরে ধীরে কমছে বহুল প্রত্যাশিত ‘নগর এক্সপ্রেস’ বাসের সংখ্যা। বর্তমানে নগরীতে এই সার্ভিসের বাস চলছে ১০ টি। যেখানে নগরে প্রতিদিন মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা, সেখানে কমছে গণপরিবহনের সংখ্যা। ফলে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়ায় রিক্সা ও সিএনজি অটোরিক্সায় চলাচল করতে হচ্ছে জনসাধারণকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ২৬ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিলেট নগরে ‘টাউন বাস সার্ভিস’ চালু করা হয়। চকচকা রঙের ২৫ সিটের ৩৫টি মিনিবাস শুরুতে টুকেরবাজার, মোগলাবাজার, হেতিমগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, দক্ষিণ সুরমার জালালপুর, বটেশ্বরসহ বেশকিছু সড়কে একযোগে চলাচল করতো। তবে লোকসান আর রোড কমে যাওয়ায় ২০১৮ সালের শেষ দিকে বন্ধ হয়ে যায় এই বাস সার্ভিসটি। কয়েক মাস বন্ধ থাকার পর ২০১৯ সালে উন্নত যাত্রীসেবার আশ্বাস দিয়ে নগরের ব্যস্ত সড়কগুলোতে নামানো হয় ‘নগর এক্সপ্রেস’। বলা হয়েছিল, নগর এক্সপ্রেসে থাকবে ওয়াই-ফাই সেবা। নারীদের জন্য থাকবে আলাদা বাস। নারীদের বাসে চালক এবং চালকের সহকারী দুজনই হবেন নারী। নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি বাসে থাকবে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে তিনটি স্কুল বাস; থাকবে ই-টিকেটিংয়ের ব্যবস্থা। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। অন্য সাধারণ বাসের মতোই চলছে ‘নগর এক্সপ্রেস’। তবে প্রতিষ্ঠার ৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এসবের কোনোটিই বাস্তবে দেখা মেলেনি। বরং ধীরে ধীরে বন্ধ হতে চলেছে জনপ্রিয় এই বাস সার্ভিসটি। জানা গেছে, ২১টি বাসের মধ্যে এখন নিয়মিত চলাচল করছে ১০-১২টি। বাকি ৯-১০টি বাসের মধ্যে ৪/৫ নষ্ট হয়ে গেছে। যেগুলো চলছে তার মধ্যে ৪/৫টি বাস অলস বসিয়ে রাখা হয় সিএনজিচালিত অটোরিকশা শ্রমিক ও পুলিশের বাধার কারণে। যে বাসগুলো চলাচল করছে সবগুলোই ভাঙাচোরা।
যাত্রার শুরুতে চলাচল করতো নগরের ১০টি রুটে। এখন সঙ্কুচিত হতে হতে মাত্র দুটি রুটে চলাচল করছে এসব বাস। অথচ একসময় এ বাসগুলোই ছিল নগরবাসীর একমাত্র গণপরিবহন। মঙ্গলবার দুপুরে নগরের বন্দরবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কের ওপর দাঁড় করিয়ে রেখে যাত্রী তুলছে নগর এক্সপ্রেসের বাস। একটি বাসের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ সিটই ভাঙাচোরা ও নোংরা।
এ বাসে থাকা এক যাত্রী বলেন, বাস কখন আসে কখন যায় এসবের ঠিক নেই। যেকোনো জায়গায় থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। ফলে গন্তব্যে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে। সিটগুলোর অবস্থাও খুব বাজে।
বাসচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাসের সিট ভাঙাচোরা, ফ্যান চলে না। এগুলো নিয়ে যাত্রীরা প্রতিদিনই ঝামেলা করে। আমরাও কর্তৃপক্ষকে জানাই। কিন্তু তারা মেরামত করে না দিলে আমাদের কিছু করার নেই। বাস সার্ভিস শুরুর পর প্রথমদিকে অনেক সাড়া পাওয়া গিয়েছিল। এখন যাত্রী কমে গেছে। ফলে বাসমালিকরাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ।
হেতিমগঞ্জ যাওয়ার জন্য নগরের উপশহর থেকে নগর পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন আমেনা আক্তার নামের এক নারী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বাসে নারীদের জন্য বরাদ্দ আসনেও পুরুষরা বসে থাকেন। নারীদের দেখেও তারা আসন ছাড়তে চান না। বাসগুলোর জন্য কোনো স্ট্যান্ড বা ছাউনিও নেই। ফলে সড়কের ওপরই যাত্রী ওঠানামা করানো হয়। এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সিলেটের মতো বিভাগীয় মেট্রোপলিটন সিটিতে গণপরিবহন না থাকা দুঃখজনক। আমরা জরুরী প্রয়োজনে রিক্সা ও সিএনজি অটোরিক্সা চালকদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ছি। টাউন বাস কিংবা নগর এক্সপ্রেস যেখানে বাস বাড়ানোর কথা সেখানে উল্টো কমছে বাসের সংখ্যা। এত জনদুর্ভোগ বাড়ছে। নগরীতে গণপরিবহন বাড়াতে সিলেট সিটি কর্পোরেশনসহ সুধী সমাজের উদ্যোগ প্রয়োজন।
তিনি বলেন, চালুর সময় নগর এক্সপ্রেস কর্তৃপক্ষের দেয়া প্রতিশ্রুতির কোন ডকুমেন্ট না থাকা বড় একটা সমস্যা। যেখানে ৪ বছরের তাদের অর্ধেক বাস কমে গেছে। সেখানে শিক্ষার্থী ও নারীদের জন্য আলাদা বাস চালুর চিন্তাও করা যাচ্ছেনা। তবুও তারা চাইলে অন্তত নগর এলাকায় সকালে শুধু শিক্ষার্থীদের পরিবহনের উদ্যোগ নিতে পারে। তাহলে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে সার্বিক বিষয়ে ‘নগর এক্সপ্রেস’ এর ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান সিটি বাস মালিক গ্রুপের একাধিক পরিচালকের সাথে আলাপকালে তারা জানান, তৎকালিন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন বাস রাখার জন্য টার্মিনাল বা শেড তৈরি করে দেবেন। এছাড়া যেসব রোডে গাড়িগুলো থামবে সেসব জায়গায় যাত্রীছাউনি নির্মাণ ও বাস থামার জায়গা চিহৃিত করে দেওয়া হবে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। বাসগুলো খোলা আকাশের নিচে থাকতে থাকতে বৃষ্টিতে ভিজে আর রোদে পুড়ে অল্পদিনেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে আমাদের ইচ্ছা থাকলেও যাত্রীদের উন্নত সেবা দিতে পারছি না।
তারা বলেন, আমরা প্রতি মাসে লোকসান দিচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের আর কিছু করার থাকবে না। এরই মধ্যে নগর এক্সপ্রেস সার্ভিস আমরা রাখবো, না কি বন্ধ করে দেবো তা নিয়ে মালিকদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। কারণ আমরা সব রোডে বাস চালাতে পারছি না অটোরিকশা ও লেগুনা শ্রমিকদের কারণে।
সিটি বাস মালিক গ্রুপের আহ্বায়ক সাবেক কাউন্সিলার মখলিছুর রহমান কামরান বর্তমানে আত্মগোপনে রয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে তার ওয়াটসআপ নাম্বারে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলতে রাজী হননি।
তবে এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি বাস মালিক গ্রুপের এক পরিচালক দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, নানা কারণে সম্ভাবনাময় এই উদ্যোগটি ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও তাদেরকে প্রতিদিন লোকসান গুণতে হচ্ছে। করোনা মহামারীর পর একের পর এক রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সংঘাত-সংঘর্ষ, দফায় দফায় বন্যাসহ নানা কারণে বাস সার্ভিসটি গতিহীন হয়ে পড়েছে। ২১টি বাস নিয়ে যাত্রা শুরুর পর বর্তমানে ১০ থেকে ১১টি বাস সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে। তবে আমরা এখনই হাল ছাড়তে রাজী নয়। আগামীতে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি হলে। নগর ভবনের চেয়ারে জনপ্রতিনিধি বসলে তাঁর সাথে আলোচনা করে এ ব্যাপারে আরো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হবে এ বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী রুহুল আলম দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, নগর এক্সপ্রেস এর সাথে সিলেট সিটি কর্পোরেশন সরাসরি জড়িত নয়। নগরবাসীকে ভোগান্তিবিহীন পরিবহনসেবা দিতে সিটি করপোরেশন একটি সিটি বাস মালিক গ্রুপের সঙ্গে সমন্বয় করে এমআরটিএ ‘মেট্রো রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি’ সুবিধা দিয়ে এ সেবা চালু করেছিলো। তৎকালিন মেয়র শুধু এটার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে নগর এক্সপ্রেস ব্যবসায় লোকসান করছে। তাই তারা বাস সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। এ ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের কোন মন্তব্য নেই।