পড়ন্ত বেলায় ফিরছেন ট্রাম্প: আশা-নিারাশার দোলাচলে বিশ্ব
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ৯:৩৫:৪০ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : জীবনের পড়ন্ত বেলায় হোয়াইট হাউসে ফিরছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর এই নতুন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে অদলবদল আসবে। যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনি বিশ্বের কিছু অংশকে অনিশ্চয়তা গ্রাস করতে পারে। ট্রাম্পের অভাবনীয় জয়ের পর এমন আশা-নিরাশার দোলাচলে এখন বিশ্ব।
যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারে শত্রু-মিত্র উভয়ের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন বদলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন সদ্য বিজয়ী রিপাবলিকান পার্টির এই প্রার্থী। অঙ্গীকার করেছিলেন ইউক্রেন যুদ্ধ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বন্ধের, ইসরায়েল-হামাস এবং লেবাননে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ বন্ধ, বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্কারোপ এবং লাখো অবৈধ অভিবাসীকে প্রত্যাবাসনের।
এবারের নির্বাচনী প্রচারে অনেক অনেক নীতিগত প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ট্রাম্প। যদিও বেশির ভাগ সময় তিনি নিজের নীতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি। তিনি অন্য কোনো দেশের বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং বাণিজ্য সুরক্ষানীতির ওপর ভিত্তি করে অথবা তাঁর ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতির ওপর ভিত্তি করে ওই সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ইউক্রেনের মতো মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি’ ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি জিতলে গাজায় ইসরায়েল-হামাস এবং লেবাননে ইসরায়েল-হিজবুল্লাহ যুদ্ধ বন্ধ করবেন বলে জোর দাবি করেছেন। কিন্তু কীভাবে এ যুদ্ধ বন্ধ করবেন, সে বিষয়ে কোনো কিছু বলেননি।
বরং ট্রাম্প বারবার এটাই বলে গেছেন, যদি জো-বাইডেনের পরিবর্তে তিনি ক্ষমতায় থাকতেন, তবে ইরানের ওপর তাঁর ‘সর্বোচ্চ চাপের’ কারণে হামাস ইসরায়েলে হামলাই চালাত না।সার্বিকভাবে ইরান বিষয়ে ট্রাম্প সম্ভবত তাঁর পুরোনো কৌশলেই ফেরত আসবেন। যেমন তিনি ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে দূরে রাখবেন। ইরানের বিরুদ্ধে বিস্তৃত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবেন। ট্রাম্পের আমলেই ইরানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী সামরিক কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র।
বিগত সময়ে ক্ষমতায় থাকাকালে ট্রাম্প কট্টর ইসরায়েলপন্থী নীতিতে থেকেছেন। তিনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং তেল আবিব থেকে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে জেরুজালেমে নিয়ে যান। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ট্রাম্পকে ‘হোয়াইট হাউসে থাকা ইসরায়েলের সবচেয়ে ভালো বন্ধু’ বলে বর্ণনা করেছেন। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ওই অঞ্চলের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আরও উসকে দিতে পারে বলে আশঙ্কা সমালোচকদের।
ফিলিস্তিনিদের দাবি অগ্রাহ্য করে ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ফিলিস্তিনিরা ট্রাম্প প্রশাসনকে বর্জন করেছিল। শুধু জেরুজালেম প্রশ্নে নয়, বরং ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’ বা ‘আব্রাহাম চুক্তি’ করার সময়ও ফিলিস্তিনিদের দাবিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে গেছেন ট্রাম্প।
আরব ও মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ট্রাম্পের উদ্যোগে ২০২০ সালের শেষে দিকে আব্রাহাম চুক্তি সই হয়। ওই চুক্তিতে ইসরায়েল ভবিষ্যৎ স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র মেনে নেবে কি না বা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংকট নিরসনে যে দ্বিরাষ্ট্র সমাধান নীতি কথা বলা হয়, তা পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প অনেকবার বলেছেন, তিনি গাজা যুদ্ধের অবসান চান।
নেতানিয়াহুর সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক বেশ জটিল, কখনো কখনো তা অকার্যকরও। তবে নিশ্চিতভাবেই নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা ট্রাম্পের আছে। গুরুত্বপূর্ণ আরব দেশগুলোর প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার ইতিহাসও আছে। ওই সব দেশের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক রয়েছে।এখন দেখার বিষয় ট্রাম্প কীভাবে একসঙ্গে ইসরায়েলের প্রতি তাঁর দৃঢ় সমর্থন প্রদর্শন এবং গাজা যুদ্ধের অবসানের চেষ্টা করেন। এ নিয়ে স্পষ্ট করে কোনো কথা এখন পর্যন্ত তিনি বলেননি।
ইউক্রেন ও ন্যাটোর ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে :
নির্বাচনী প্রচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার বলেছেন, তিনি ‘এক দিনের মধ্যে’ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। উত্তর আটলান্টিক প্রতিরক্ষা সামরিক জোটের (ন্যাটো) কার্যকারিতা নিয়ে ট্রাম্প আগেই সংশয় প্রকাশ করেছেন।
বড় ব্যবধানে জয়ী হয়ে আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরে যাচ্ছেন ট্রাম্প। বৈদেশিক নীতি ও কৌশল বিষয়ে ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তা আগে থেকে অনুমান করা খুবই কঠিন। তাই তিনি নিজের আগের মেয়াদের বিদেশনীতিতে এবারও অবিচল থাকবেন, নাকি পরিবর্তন আনবেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ‘ঘনিষ্ঠ’। এবারের নির্বাচনী প্রচারে তাঁর ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিস বেশ কয়েকবার ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেছেন। কমলা বলেছেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) চান, ইউক্রেন আত্মসমর্পণ করুক। এতে পুরো ইউরোপ বিপদে পড়বে।’
ট্রাম্প নিজে কীভাবে ‘এক দিনে’ ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করবেন, সে ব্যাখ্যা দেননি; বরং তিনি যুদ্ধ বন্ধে একটি চুক্তির উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু বলতে অস্বীকার করেছেন তিনি।
৮ বছর আগের দুশ্চিন্তার মেঘ :
আগামী চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের হর্তাকর্তা হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আবির্ভূত হওয়ায় দুশ্চিন্তার মেঘ আবার ছেয়েছে। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন, ‘কপ ২৯’ শুরুর প্রাক্কালে মার্কিন মুলুকের এই পালাবদল হুট করে আট বছর আগের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে। সংশয় জেগেছে প্রবল, তবে কি জলবায়ু পরিবর্তনের এই অর্জন নতুন করে পড়তে চলেছে জলে?
সংশয়ের কারণ, আট বছর আগে ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। সেবার ২০১৬ সালের নভেম্বরে, মরক্কোর মারাকেশে বসেছিল বার্ষিক জলবায়ু সম্মেলন। সম্মেলন শুরু হয়েছিল ট্রাম্পের জয়ের খবর দিয়ে। উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। কারণ, নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প বারবার জলবায়ু পরিবর্তন ও সেই সম্পর্কিত আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, জলবায়ু আন্দোলন এক ‘ব্যয়বহুল ধাপ্পাবাজি’। যুক্তিহীন, অহেতুক এবং সেটা ‘চীনের স্বার্থে চীনাদের তৈরি’। এসব মন্তব্য ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছিল তাঁর ঘোষণা। বলেছিলেন, প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসবে।
উল্লেখ্য যে, ট্রাম্পের অভিষেক ২০ জানুয়ারির আগে হবে না। ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত জো বাইডেনই ক্ষমতায় থাকবেন। যদিও তিনি রাজনৈতিকভাবে খুব সীমিত ক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে পারবেন।