নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কমছে, ঋণ নিচ্ছে না বেসরকারি খাত
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০১:০৮ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটছে। ঊর্ধ্বমুখী সুদহার, আমদানি কমা ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন করে বিনিয়োগেও আগ্রহ হারাচ্ছে বেসরকারি খাত। এতে গেল সেপ্টেম্বরে এ খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে ৯ দশমিক ২০ শতাংশে নেমেছে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ প্রবৃদ্ধি। ২০২১ সেপ্টেম্বরে সর্বনি¤œ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এরপর কখনোই ৯ দশমিক ২০ শতাংশের নিচে নামেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও স্থিতিশীল নয়। এমন অনিশ্চয়তার পরিবেশে কেউ নতুন বিনিয়োগ করবে না। আবার এ সময় যোগাযোগ ব্যবস্থার বিঘœতার কারণে এলসি খোলাও কমেছে, তারও প্রভাব রয়েছে। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ধারাবাহিকভাবে নীতি সুদহার বাড়ছে। এতে ব্যাংকঋণের সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। তাই ব্যবসায়ীরা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগে পিছু হাঁটছে। তাই বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলা ও নিষ্পত্তি উভয়ই কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর তিন মাসে ১৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার কম। শতাংশের হিসাবে তা ৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর এলসি খোলা হয়েছিল ১৬ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারের। দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার অন্যতম একটি সূচক হলো মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি নিরূপণ। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা কমেছে প্রায় ৪১ শতাংশ।
এদিকে এক বছর আগে ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। এখন তা বেড়ে কোনো কোনো ব্যাংকে ১৫ শতাংশ হয়েছে। সব ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহারও ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৭০ শতাংশ। মূলত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বা পলিসি রেট বাড়িয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে নীতি সুদহার ১০ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের দাম কমায় সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমলেও অক্টোবরে তা বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ানোর পরও গত বছরের মার্চ থেকে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) ১০ শতাংশের আশপাশে ছিল। তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে সিপিআই ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা আগস্টে কমে ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ ও সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে অক্টোবরে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ।
মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে এ ঘোষণা দিয়েছে। গত অর্থবছরের জুন পর্যন্ত প্রকৃত প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক ৮০ শতাংশে। যদিও সেপ্টেম্বরের বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি এখনও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার নিচেই রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে বকেয়া ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৫ হাজার ২২৪ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৫ লাখ ১৩ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। যদিও ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর তার আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর চলতি বছরের আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির উদ্দেশ্যই হলোÑবেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমাতে হবে। তাতে টাকার সরবরাহ কমলে মূল্যস্ফীতি কমে আসতে পারে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমা একটা সাফল্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। এখন পর্যালোচনা করতে হবে যে টাকার সরবরাহ কমার কারণে মূল্যস্ফীতি কমছে কি না।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের ওপর মূল্যস্ফীতি ওঠানামা করেÑমন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে ঋণের প্রবাহ কমানো গেলে মূল্যস্ফীতি কমবে কি, কমবে না সেটার কোনো নিশ্চয়তা না এলেও আরও চড়াও হওয়া বন্ধ করা যায়। সেই দিক থেকে পর্যালোচনা করলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমানো উদ্দেশ্য ছিল। ঋণ প্রবৃদ্ধি কমার কারণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কার্যকর হওয়ার বিষয়টি ইঙ্গিত দিচ্ছে।’