সরকার কী পথ হারাচ্ছে?
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০২৪, ৮:১১:৪৯ অপরাহ্ন
উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা-বিক্ষোভ
জালালাবাদ প্রতিবেদন :
ঐতিহাসিক ছাত্র-গণ অভ্যূত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের তিন মাস পার হয়েছে। সহস্র শহীদের রক্তের সৌধের উপর নির্মিত এ সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে নানা চর্চা চলছে, আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
তিন মাসে সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারে কমিশন গঠনসহ কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ছে এবং প্রশংসিত হচ্ছে। তবে যে ব্যর্থতা অমার্জনীয় হয়ে উঠেছে, তা হচ্ছে, নিত্যপণ্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে না পারা। হাসিনার আমলে মানুষের জীবনযাপন যে কষ্টের মধ্যে ছিল, এখনও সেই অবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে।
এছাড়া প্রশ্ন আছে, গণবিপ্লবে শহীদ ও আহতদের সঠিকভাবে সরকার মূল্যায়ন করতে পেরেছে কিনা। এখনো আহতরা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছে না। অনেকে শরীরে বুলেট নিয়ে যন্ত্রণাদায়ক জীবন কাটাচ্ছে। অনেকে অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না। এখনো হাজারো ছাত্র-জনতা হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনা যায়নি। গুলিবর্ষণকারী পুলিশ সদস্যদের অনেকেই বহাল তবিয়তে। তদন্ত কর্মকর্তারা নানা ফন্দি-ফিকির করছেন এদের বাঁচাতে।
রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে নানা সংস্কার কমিশন হয়েছে। কিন্তু এখনো এই কমিশনগুলোর দৃশ্যমান উল্লেখ করার মতো অগ্রগতি নেই। রাষ্ট্র সংস্কার এখনো সুদূর পরাহত। এখনো নির্বাচনী রোডম্যাপ তৈরী হয়নি।
বিপ্লবী ছাত্র-জনতার অনেকের মতে, এ সরকারের বেশিরভাগ উপদেষ্টার যেভাবে বিপ্লবী চেতনা ধারন করা উচিৎ ছিল, তা ধারন করতে পারেনি। ৮৪ বছরের ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২২ বছরের টগবগে তরুণের চেতনা ধারন করলেও বেশিরভাগ উপদেষ্টার কেউ বয়সের ভারে, নতুবা অন্যকোনো উদ্দেশ্যে তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। যেভাবে বিপ্লবী চেতনা ধারণ করার কথা, সেভাবে তারা হয়ে উঠতে পারেনি।
এ নিয়ে যখন আলোচনার ঝড় বইছে ঠিক তখনই সরকার নতুন ঘটনার জন্ম দিয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদে এমন কিছু ব্যক্তিকে স্থান দেয়া হয়েছে যাদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। এ অবস্থায় অনেকে প্রশ্ন করছেন-অন্তবর্তী সরকার কী পথ হারাচ্ছে?
গত রোববার মন্ত্রী মর্যাদায় উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন সেখ বশির উদ্দিন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ও মাহফুজ আলম। এছাড়া প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনজনকে বিশেষ সহকারী নিয়োগ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনজন বিশেষ সহকারী হলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) খোদা বকশ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক সায়েদুর রহমান এবং অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম।
তাদের শপথের পর কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে সোমবার বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সমাবেশে বলা হয়, ছাত্র-জনতার অংশীদারিত্ববিহীন সিদ্ধান্ত কোনভাবেই মেনে নেয়া হবে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছেন, ছাত্র-জনতার মতামত না নিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করে এমন কাউকে উপদেষ্টা পরিষদে মেনে নেয়া হবে না।তিনি বলেছেন, জুলাই-আগস্টে যে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে, আহত হয়েছে তাদের চাওয়া বা আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থি ব্যক্তিদের আমরা উপদেষ্টা পরিষদে দেখতে চাই। সোমবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত সমাবেশে থেকে তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন।
হাসনাত বলেন, ছাত্র-জনতার সঙ্গে মশকরা হচ্ছে। ধানমন্ডির ৩২কে যারা কাবা মনে করে তাদের উপদেষ্টা করা হয়েছে। কার মদদে, প্রশ্রয়ে আওয়ামী পুনর্বাসনের এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে আমরা তা জানতে চাই। ফ্যাসিবাদের যারা দোসর, ‘২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে কোনো ফরম্যাটেই তাদের দেখতে চাই না। উপদেষ্টা হিসেবে যাদের নিয়োগ দিচ্ছেন গত ১৬ বছরে তারা কী করেছেন তার ইতিহাস আমরা জানতে চাই। তিনি বলেন, আমাদের হারাবার কিছু নাই। ৫ আগস্টের পর আমাদের বোনাস লাইফ।
উপদেষ্টাদের মধ্যে যাদের নিয়ে বেশি সমালোচনা হচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সেখ বশির উদ্দিন ও মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। এরমধ্যে সেখ বশির উদ্দিনকে দেয়া হয়েছে বাণিজ্য উপদেষ্টার দায়িত্ব। আর মোস্তফা সরয়ার ফারুকী কে দেয়া হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
অভিযোগ উঠেছে, সেখ বশির উদ্দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সোহান শাহ নামের (৩০) এক যুবককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় আসামির তালিকায় আছেন।মামলার ৫৭ জন আসামির মধ্যে ৪৯ নম্বর তালিকায় নাম রয়েছে শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়ার। পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগ নেতা। বাবার নাম শেখ আকিজ উদ্দিন ভূঁইয়া। মামলার ৪৮ নম্বরে আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে শেখ আফিল উদ্দিন ভূঁইয়া। পরিচয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি সাবেক সংসদ সদস্য, যশোর-১। বাবার নাম শেখ আকিজ উদ্দিন ভূঁইয়া।
মরহুম সেখ আকিজ উদ্দিন আকিজ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি আকিজ। সেখ আকিজের ছেলেদের মধ্যে সেখ আফিল উদ্দিন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন।সেখ আকিজের সন্তানেরা আলাদাভাবে ব্যবসা করেন। সেখ বশির উদ্দিন আকিজ-বশির গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে রোববার শপথ নেন সেখ বশির উদ্দিন। তার পর থেকে মামলার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’ নাম দিয়ে সেখ বশির উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে কি না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন সেখ বশির উদ্দিন। তিনি বলেছেন, নামের আংশিক সংগতি ও অসংগতি থাকলেও তিনি নিশ্চিত নন, মামলাটি তাঁর নামে হয়েছে কি না। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া ও সেখ বশির উদ্দিন একই ব্যক্তি কি না, তারা খতিয়ে দেখছে।
এদিকে, অনেকটা চমক দেখিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে জায়গা করে নিয়েছেন নির্মাতা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। তাকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন মহলে সমালোচনা হচ্ছে, ফারুকীকে উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়ায় সমালোচনা হচ্ছে সরকারেরও।
মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীকে উপদেষ্টা পদ থেকে অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত বিভিন্নজনের অভিযোগ, মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীকে উপদেষ্টা করা গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে।
অনেকে লিখেছেন, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বিভিন্ন সময় তার লেখায় ও ফেসবুক পোস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার প্রশংসা করেছেন। যার ফলে গত ১৫ বছর প্রিয়ভাজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন আওয়ামীলীগ সরকারের। এ সুবাদে সরকারের বিভিন্ন সুবিধাও গ্রহণ করেছেন তিনি। শুধু তিনি নন, তার স্ত্রী অভিনেত্রী নুসরাত ইমরোজ তিশাও গ্রহণ করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের নানা সুবিধা। যার ফলে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ায় সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। এছাড়াও তিনি ফারুকীর উপদেষ্টা হওয়ার যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেন। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড ফাজলামো না, এটা বোঝার মত কাণ্ডজ্ঞান থাকা উচিত। ফারুকী উপদেষ্টা হওয়ার কোন প্রকারের যোগ্যতা রাখেন না। এতটা বছর লীগের আস্থাভাজন থেকে কাজ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে গেছেন তিনি। ফ্যাসিবাদ একদিনে তৈরি হয় না, চুপ থেকে সমর্থন করার মধ্যেও ফ্যাসিবাদ তৈরি হয়।
এছাড়াও তার বিরুদ্ধে পতিত দল আওয়ামী লীগের ভোট চুরির নির্বাচন ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করার অভিযোগ আনার একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। প্রায় ৩ হাজার লাইকের এই পোস্টে উল্লেখ আছে যে, সাবেক মেয়র আনিসুল হকের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে ফারুকীর সংশ্লিষ্টতা। পোস্টকারীর পরিচয় সাদিকুর রহমান খান। ফেসবুকে তার প্রায় ১ লক্ষ ফলোয়ার রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরো কত শত ব্যক্তি স্ট্যটাস দিয়েছেন, সমালোচনা করছেন। অবিলম্বের তাকে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বাদ দেয়ার দাবি করছেন। এরমাঝে একজনের স্ট্যটাস সত্যিই ভাবনার জন্ম দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, সারাদেশের দেয়ালে দেয়ালে এখনো ফ্যাসিস্ট হাসিনাবিরোধী শিহরণ জাগানিয়া বিপ্লবী কথামালা রয়ে গেছে। এক সময় হয়তো দেয়ালের লেখা বৃষ্টিতে মুছে যাবে। দেয়ালের নতুন রংয়ে ঢাকা পড়ে যাবে। বিপ্লবীদের এই কথামালা মুছে যাওয়ার আগেই ছাত্র-জনতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে উঠবে কি না!