পায়রার তুলনায় আদানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ২৫% বেশি
প্রকাশিত হয়েছে : ১১ নভেম্বর ২০২৪, ৯:৩৯:৪৭ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক : উৎপাদন শুরুর আগে থেকেই আদানির চুক্তি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক আপত্তি তুলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। আর আদানির বিদ্যুৎ আসা শুরু হয় ২০২৩ সালের মার্চে। মূলত কয়লার অতিরিক্ত দামের কারণে আদানির বিদ্যুৎ কেনায় অস্বীকৃতি জানায় পিডিবি। এতে বাধ্য হয়েই কয়লার দাম কমাতে সম্মত হয় আদানি। এরপরও আদানির কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ছে দেশের অন্যান্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি।
সূত্র জানায়, ডলার সংকটে নিয়মিত কয়লা আমদানি করতে না পারায় বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগে নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এছাড়া কারিগরি ত্রুটিতেও মাঝে মধ্যে বন্ধ থাকে কোনো না কোনো কেন্দ্র। আর কয়লা সংকটে একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটির একটি ইউনিট বছরের বেশিরভাগ সময় বসে থাকে। নিয়মিত বিল পরিশোধ না করায় বিভিন্ন সময় আদানিও বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল। ফলে বসিয়ে রেখেই এসব কেন্দ্রের পূর্ণ সক্ষমতার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়।
পিডিবির তথ্যমতে, কয়লাভিত্তিক পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে গত অর্থবছর সবচেয়ে কম গড় ব্যয় ছিল পায়রার। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট। গড়ে সক্ষমতার ৮৫ শতাংশ চলার কথা থাকলেও মাঝে কয়লা সংকটে বেশকিছু দিন একটি ইউনিট বন্ধ ছিল। এছাড়া পুরো কেন্দ্রও বন্ধ ছিল কয়েকদিন। ফলে ২০২৩-২৪ অর্থবছর কেন্দ্রটির সক্ষমতার ৬৯ শতাংশ ব্যবহার হয়। এতে উৎপাদন হয় ৭৫৪ কোটি ৮৭ লাখ ৩৭ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ।
এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় লাগে চার হাজার ৬১৫ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ গড় জ্বালানি ব্যয় পড়ে ছয় টাকা ১১ পয়সা, যা সবচেয়ে কম। এছাড়া কেন্দ্রটির জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয় চার হাজার ৩৪০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এতে গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পড়ে পাঁচ টাকা ৭৫ পয়সা। সব মিলিয়ে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যয় হয় আট হাজার ৯৫৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ গড় ব্যয় পড়ে ১১ টাকা ৮৬ পয়সা, যা কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম।
২০২৩-২৪ অর্থবছর গড় উৎপাদন ব্যয়ের দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বরিশাল ইলেকট্রিক কেন্দ্রটি। এ কেন্দ্রটির সক্ষমতা ৩০৭ মেগাওয়াট। তবে গত অর্থবছর এর সক্ষমতার ৪৬ শতাংশ ব্যবহার হয়। এতে কেন্দ্রটি থেকে গত অর্থবছর প্রায় ১২৫ কোটি এক লাখ ১০ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে। কয়লা সংকটে কেন্দ্রটির সক্ষমতার অর্ধেকও ব্যবহার হয়নি। এরপরও কেন্দ্রটির জন্য গত অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৭১৬ কোটি টাকা। আর মোট ব্যয় ছিল এক হাজার ৫৬৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
গত অর্থবছর কেন্দ্রটির বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়েছে ইউনিটপ্রতি ছয় টাকা ৫৪ পয়সা। আর ক্যাপাসিটি চার্জ পড়েছে গড়ে পাঁচ টাকা ৭৩ পয়সা এবং গড় ওঅ্যান্ডএম (পরিচালক ও রক্ষণাবেক্ষণ) ব্যয় ২৯ পয়সা। অর্থাৎ গড় উৎপাদন ব্যয় পড়েছে ১২ টাকা ৫৬ পয়সা।
পিডিবির মালিকানাধীন বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের তিনটি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ১ ও ২ নং ইউনিটের সক্ষমতা ১৭০ মেগাওয়াট, যা গত বছর মাত্র চার শতাংশ চলেছে। কয়লা সংকটে এটি বছরের প্রায় পুরোটা সময় বন্ধ ছিল। তবে তৃতীয় ইউনিটটির সক্ষমতা ২৭৪ মেগাওয়াট, যা চলেছে ৬২ শতাংশ। সম্মিলিতভাবে কেন্দ্রটির ৪৪৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছর গড়ে ৪০ শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। এতে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১৫৬ কোটি এক লাখ ৮০ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ।
এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়েছে ৯ টাকা ৬৬ পয়সা, যা সবচেয়ে বেশি। বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চেয়ে অনেক বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম ওঠানামা করলেও দেশে বড়পুকুরিয়ার কয়লার দাম পরিবর্তন হয় না। এ কয়লা প্রতি টন কিনতে পিডিবিকে গুনতে হয় ১৭৬ ডলার। যদিও বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে ভালোমানের কয়লার দাম ১২০ ডলারের নিচে। উচ্চ দামে কয়লা কেনায় এর জ্বালানি ব্যয় বেশি পড়ছে।
গত অর্থবছর বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য স্থায়ী ব্যয় তথা বেতন-ভাতা এবং রক্ষণাবেক্ষণে ব্যয় হয়েছে গড়ে দুই টাকা ৯০ পয়সা এবং ১২ পয়সা। অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়েছে ১২ টাকা ৬৮ পয়সা। এদিকে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রটির কয়লার দাম বেসরকারি অন্য কেন্দ্রের চেয়ে তুলনামূলক বেশি পড়ছে। কেন্দ্রটির উৎপাদন সক্ষমতা এক হাজার ২৩৪ মেগাওয়াট। তবে এর মাত্র ২৯ শতাংশ গত অর্থবছর ব্যবহার হয়েছে। কয়লা সংকটে কেন্দ্রটির একটি ইউনিট বছরের বেশিরভাগ সময় বন্ধ ছিল। অপর ইউনিটও কারিগরি ত্রুটির কারণে লম্বা সময় বন্ধ ছিল। এতে গত অর্থবছর রামপালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩১৩ কোটি ৩২ লাখ ৯৬ হাজার ইউনিট।
এ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি ব্যয় পড়েছে ইউনিটপ্রতি সাত টাকা ২০ পয়সা। আর গড় ক্যাপাসিটি চার্জ পড়েছে ছয় টাকা আট পয়সা। এতে কেন্দ্রটিতে গড় উৎপাদন ব্যয় পড়েছে ১৬ টাকা ১২ পয়সা।
পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, রামপালের পরিবর্তে পায়রার সঙ্গে তুলনা করে দাম নির্ধারণ করলে আদানির কেন্দ্রটির জ্বালানি বিল আরও প্রায় দেড় টাকা কমানো যেত। তবে আদানি কয়লার দাম না কমিয়ে উল্টো জুলাই থেকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা এখন আন্তর্জাতিক বাজারের কয়লা সূচকের ভিত্তিতে দাম চাচ্ছে। এতে কয়লার দাম বাজার মূল্যের চেয়ে ২২ শতাংশ বেশি দিতে হবে। এ নিয়ে পিডিবি আপত্তি তুললেও আদানি রাজি হয়নি। তাই আদানির চুক্তিটি সরকারের পক্ষ থেকে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, আদানির বিদ্যুৎ কেনায় গত অর্থবছয় ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ১১৩ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল পাঁচ হাজার ৮২৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা। যদিও এ সময় কেন্দ্রটির সক্ষমতার ৬২ শতাংশ চলেছে।