দেশীয় গ্যাস উৎপাদন কমে ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৮:২৬:০৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক : দেশে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুত ক্রমেই কমছে। গত জুন শেষে উত্তোলনযোগ্য মজুতের মাত্র ২৯ শতাংশ অবশিষ্ট ছিল। সর্ববৃহৎ উৎস মার্কিন কোম্পানি শেভরনের ক্ষেত্রগুলোয় গ্যাস প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। দেশীয় কোম্পানিগুলোও সরবরাহ বাড়াতে পারছে না।অন্যদিকে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মীমাংসা হলেও গত এক দশকে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করা হয়নি। এর প্রভাব পড়েছে গ্যাস উৎপাদনে। গত অর্থবছর দেশীয় গ্যাস উৎপাদন ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে গেছে।
পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর দেশে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ২১ হাজার ৭৪ দশমিক ৫৭৬ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর আগের (২০২২-২৩) অর্থবছর দেশে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৫ দশমিক ৬১৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। অর্থাৎ গত অর্থবছর গ্যাস উৎপাদন কমেছে এক হাজার ৫৭১ দশমিক ০৩৮ মিলিয়ন ঘনমিটার বা প্রায় সাত শতাংশ। এ নিয়ে টানা তিন বছর দেশে গ্যাস উৎপাদন কমল।
দেশে এর চেয়ে কম গ্যাস উৎপাদন হয়েছিল ২০১১-১২ অর্থবছর তথা এক যুগ আগে। ওই অর্থবছর দেশে গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৫৯ দশমিক ২৩৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। তার আগের (২০১০-১১) অর্থবছর গ্যাস উৎপাদন হয়েছিল আরও কম ২০ হাজার ৭৩ দশমিক ৮১৩ মিলিয়ন ঘনমিটার। অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবছর গ্যাস উৎপাদন বেড়েছিল প্রায় পাঁচ শতাংশ। পরের দুই অর্থবছরও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছর ২৩ হাজার ২৩১ দশমিক ৯২৮ মিলিয়ন ঘনমিটার ও ২০১৪-১৫ অর্থবছর ২৫ হাজার ২৬৩ দশমিক ৪৫১ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস উৎপাদিত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গ্যাস উৎপাদন কমার মূল কারণ হচ্ছে দেশে কার্যরত বহুজাতিক কোম্পানি (আইওসি) শেভরনের ক্ষেত্রগুলোয় গ্যাস ফুরিয়ে আসা। এতে টানা তিন অর্থবছর ধরে গ্যাস উৎপাদনে আইওসির হিস্যা কমছে, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক গ্যাস উৎপাদনে। আগামীতে শেভরনের অধীনে থাকা ক্ষেত্রগুলোয় গ্যাস পুরোপুরি ফুরিয়ে যাবে। তাই দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন সক্ষমতা দ্রুত বাড়াতে না পারলে গ্যাস খাতে দুই-তিন বছরের মধ্যে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শেভরনের সরবরাহকৃত গ্যাস অভাবনীয় হারে কমে যাবে। তাদের বর্তমান উত্তোলন যদি অর্ধেকে নেমে যায়, সে পরিমাণ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করার মতো সক্ষমতা দেশীয় কোম্পানিগুলোর নেই। এটি নিয়ে বড় আকারের কোনো পরিকল্পনাও নেয়নি বিগত সরকার। তাই কয়েক বছরের মধ্যে গ্যাস খাতে মহাসংকট আসতে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, কয়েক বছর ধরে দেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করছে মার্কিন কোম্পানি শেভরন। কোম্পানিটির অধীন তিনটি ক্ষেত্রে সম্ভাব্য গ্যাস মজুত ছিল সাত দশমিক ৬১২৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ)। যদিও সাত দশমিক ৯৮৩৮ টিসিএফ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। অর্থাৎ শেভরনের অধীন ক্ষেত্রগুলোর সক্ষমতা আগেই ফুরিয়ে গেছে। বর্তমানে যে গ্যাস উঠছে তা দ্বিমাত্রিক জরিপের বাইরে থাকা মজুত। এ উত্তোলন যে কোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে কোম্পানিটির অধীন বিবিয়ানা ও জালালাবাদ ক্ষেত্রে গ্যাস উত্তোলন দ্বিমাত্রিক জরিপে পাওয়া সম্ভাব্য মজুতকে ছাড়িয়ে গেছে। শুধু মৌলভীবাজার ক্ষেত্রে কিছু গ্যাস মজুত রয়েছে। যদিও তা তুলনামূলক ছোট ও সক্ষমতা কম।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত অর্থবছর গ্যাস উৎপাদনে আইওসির হিস্যা ছিল প্রায় ৬১ শতাংশ, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডসের ২৮ শতাংশ, সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের পাঁচ শতাংশ ও বাপেক্সের ছয় শতাংশ। যদিও তিন অর্থবছর আগে গ্যাস উৎপাদনে আইওসির হিস্যা ছিল ৬৫ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছর তা কমে হয় ৬৩ শতাংশ ও ২০২২-২৩ অর্থবছর ৬২ শতাংশ। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বেশি গ্যাস মজুত আছে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস ও সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের কাছে। ওই দুই কোম্পানির কাছেই মোট মজুতের প্রায় ৯০ শতাংশ গ্যাস রয়েছে। তবে তারা তুলনামূলক কম গ্যাস উত্তোলন করছে। মোট মজুতের ৫৮ শতাংশ সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের কাছে থাকলেও গত অর্থবছর কোম্পানিটি মজুতের এক শতাংশেরও কম (০.৬৯%) উত্তোলন করেছে।
পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, এক যুগের মধ্যে দেশে সবচেয়ে বেশি গ্যাস উৎপাদন হয় ২০১৫-১৬ অর্থবছর। ওই অর্থবছর গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৫৫৯ দশমিক ২৫৫ মিলিয়ন ঘনমিটার। এর পরের অর্থবছর গ্যাস উৎপাদন কিছুটা কমে দাঁড়ায় ২৭ হাজার ৪৪৫ দশমিক ৩৬৪ মিলিয়ন ঘনমিটার। তা আরও কিছুটা কমে ২০১৭-১৮ অর্থবছর হয় ২৭ হাজার ৪২৯ দশমিক ৯৮৩ মিলিয়ন ঘনমিটার ও ২০১৮-১৯ অর্থবছর ২৭ হাজার ২৩২ দশমিক ৫৯৭ মিলিয়ন ঘনমিটার। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এতে ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) দেশের প্রায় সব ধরনের শিল্প-কারখানা বন্ধ ছিল। ওই সময় চাহিদা কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রায় অর্ধেকই বন্ধ রাখা হয়, পরিবহন বন্ধ থাকায় সিএনজির চাহিদা হ্রাস পায়, সার কারখানাগুলোও বন্ধ ছিল। সার্বিকভাবে অর্থনীতি স্থবির হয়ে যায়। এতে চাহিদা কমায় ২০১৯-২০ অর্থবছর গ্যাস উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৯৯২ দশমিক ৮৫২ মিলিয়ন ঘনমিটার।
পরের (২০২০-২১) অর্থবছর অর্থনীতি আবার পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় গ্যাস উৎপাদন বেড়ে হয় ২৫ হাজার ১৭৩ দশমিক ৬৩৯ মিলিয়ন ঘনমিটার। তবে চাহিদা থাকার পরও গত তিন অর্থবছর ধরে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না, বরং কমছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ অর্থবছর গ্যাস উৎপাদনের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৭৮৩ দশমিক ১০৪ মিলিয়ন ঘনমিটার, যা পরের অর্থবছর প্রায় চার দশমিক ৭৮ শতাংশ ও গত অর্থবছর প্রায় ছয় দশমিক ৯৪ শতাংশ কমে। উল্লেখ্য, দেশে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মজুতের পরিমাণ ২৯ দশমিক ৯২৬৫ টিসিএফ। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়েছে ২১ দশমিক ০৯৯৪ টিসিএফ, যা মজুতের ৭০ দশমিক ৫০ শতাংশ। ওই সময় দেশে অবশিষ্ট গ্যাস মজুত ছিল আট দশমিক ৮২৭১ টিসিএফ বা ২৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। যদিও অবশিষ্ট মজুত থেকে শেষ দিকে চাপ কমে যাওয়ায় কিছু গ্যাস হয়তো উত্তোলন করা যাবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।