অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন : প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তি কত?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ৩:৩৫:২৫ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: ছাত্র-গণঅভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার ১শ’ দিন পূর্ণ করলো গতকাল ১৫ নভেম্বর। ১শ’ দিনের এই মাইলফলকে প্রত্যাশা সাথে প্রাপ্তি কতটুকু আর এর মধ্যে ফারাক কত তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীী সরকার দায়িত্ব নেয়।
দায়িত্ব নেয়ার পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, নির্বাচনব্যবস্থা, দুর্নীতি প্রতিরোধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এইসব সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোরও পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান রয়েছে। বিএনপি বিভিন্ন সময় বলার চেষ্টা করছে যে, সংস্কারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নির্বাচন। সংস্কারে অন্তবর্তী সরকারের ম্যান্ডেট নিয়েও প্রশ্ন তুলছে তারা। তবে এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে রয়েছে অন্যতম বড় দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। তারা বলছে, একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাষ্ট্র সংস্কার।
তবে এসব সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয় বলে উল্লেখ করেছে ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। বৈশ্বিক এ সংস্থা বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ-সংঘাত প্রতিরোধে কাজ করে এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়তে পরামর্শ দিয়ে থাকে। মারাত্মক ধরনের সংঘাতে আগাম সতর্কতা দিয়ে থাকে আইসিজি। সংস্থাটি বলছে, উচ্চাকাঙ্খী সংস্কারের চাপ কতটা সামলাতে পারবে সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বৃহস্পতিবার রাতে ‘আ নিউ এরা ইন বাংলাদেশ? দ্য ফার্স্ট হানড্রেড ডেজ অব রিফর্ম’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দুর্নীতি, অনিয়ম, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থায় দলীয়করণ, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করাসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নানা সংস্কার বাস্তবায়নে কিছু সুপারিশও করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
রাষ্ট্র সংস্কার :
সংস্কার আনতে গত ১১ সেপ্টেম্বর ৬টি কমিশন গঠন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস। কমিশনগুলোর প্রধান করা হয়েছে নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সাবেক আমলাদের। কমিশনগুলো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ক্ষেত্রে কাজ করবে। এগুলো হলো বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি ও সংবিধান।
কমিশনগুলোর সংস্কার কমিটি গত ১ অক্টোবর কাজ শুরু করেছে এবং চলতি বছরের শেষ নাগাদ তারা প্রতিবেদন জমা দেবে। পরে অন্তর্বর্তী সরকার এ ছয় ক্ষেত্রে তাদের সংস্কার পরিকল্পনা শেষ করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে এবং জনগণের মতামত নেবে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রম অধিকার ও নারী বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আরও চারটি কমিশন গঠন করেছে সরকার।
শাসনকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজানো :
সংস্কার কর্মসূচিগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে কঠিন কাজটি হবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজানো। ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা খর্ব করতে কাজ করেছেন, যাতে এগুলো তাঁর আদেশ প্রতিপালন করে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিজ কর্মী-সমর্থকদের নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁদের পদোন্নতি দিয়ে ক্ষমতাশালী করেছেন বা তাঁদের ওপরের কর্মকর্তাদের নানাভাবে দুর্বল করেছেন। ইতিমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিচার বিভাগ, আমলা ও পুলিশের বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ও মাঝারি স্তরের কর্মকর্তাকে বদলি করেছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রতিষ্ঠানে এখনো রয়ে গেছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অনেক কর্মকর্তা। আওয়ামীলীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সবাইকে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরিয়ে দেওয়া বাস্তবসম্মতও নয়। সরকার চাইছে এই কর্মকর্তাদের সংস্কার কর্মসূচির অংশীদার হওয়ার সুযোগ দিতে। আইসিজি’র প্রতিবেদনে এটিকে সবেচেয়ে কঠিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বিচার বিভাগ :
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা কখনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে পুরোপুরি নিরাপদ ছিল না। তবে হাসিনার সময় এ হস্তক্ষেপ উদ্বেগজনক মাত্রায় রূপ নেয়। রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে তাঁর প্রশাসন আদালতকে ব্যবহার করে। ২০১৭ সালে প্রধান বিচারপতিকেও (এস কে সিনহা) পদত্যাগ করতে হয় চাপের মুখে। এর আগে তাঁর নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের বেঞ্চ জাতীয় সংসদ বিচারপতিদের অপসারণ করতে পারবে না বলে রায় দিয়েছিলেন। রায়ের পর নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর হুমকির মুখে দেশ ছেড়ে চলে যান তিনি। পরে দৃশ্যত দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দেশের প্রধান বিচারপতি চলে যাওয়ার পর হাসিনা স্পষ্ট বার্তা দেন যে বিচার বিভাগের যে কেউ তাঁকে অমান্য করলে তাঁর পরিণতি হবে শোচনীয়।
হাসিনার ক্ষমতার শেষ দশকে বিচারব্যবস্থা হাজার হাজার, কারও অনুমান লাখ লাখ মামলায় বাঁধা পড়ে। এসব মামলা হয় বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। মামলা হয়েছে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধেও। অভিযোগগুলো ছিল অতি তুচ্ছ বা প্রায়ই অস্তিত্বহীন প্রমাণের ভিত্তিতে। কিন্তু বিচারকেরা প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয়ে মামলা খারিজ করতে নারাজ ছিলেন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনতে এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার অল্প কিছুদিন পর ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে সাবেক প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ সৈয়দ রেফাত আহমেদ। জুলাই ও আগস্টে বিক্ষোভকারী নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অন্যায্য মামলাগুলো তুলে নেওয়া হচ্ছে। এর আগে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোও ধাপে ধাপে প্রত্যাহার হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
‘মানুষের আস্থার সংকট’ নিরসনে গত ২১ সেপ্টেম্বর বিচার বিভাগীয় সংস্কারের একটি রূপরেখা তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি। তাঁর মূল পরিকল্পনা বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ দূর করে সুপ্রিম কোর্টের অধীন একটি আলাদা সচিবালয় গঠন করা।
অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে নিম্ন আদালতের তিন শতাধিক বিচারককে বদলি এবং পদোন্নতি দিয়েছে। একজন জ্যেষ্ঠ বিচারক ক্রাইসিস গ্রুপকে বলেন, তাঁর সহকর্মীরা এরই মধ্যে এক নতুন স্বাধীনতা অনুভব করছেন। তাঁর কথায়, ‘সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে রাজনীতিকরণ ও চাপের ক্ষেত্রে। আমরা আগে যে রাজনীতিকরণ ও চাপের শিকার হয়েছি, এখন সেসবের কিছু ঘটছে না।’
প্রশাসন :
প্রশাসনের ক্ষেত্রেও একই রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার। আমলাতন্ত্র তথা প্রশাসনে দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ফেরাতে এ সরকার বিচার বিভাগের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। আমলাতন্ত্রের আকার বিবেচনায় এ কাজ বিশাল। অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে, আওয়ামীলীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত কর্মকর্তাদের সরিয়ে দিচ্ছে এবং এর আগে (আওয়ামী লীগ সরকার আমলে) যেসব সরকারি কর্মকর্তাকে জোর করে অবসরে পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের ফেরত আনছে।
সরকার গত আগস্টে তিন ব্যাচের ৪০০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার ঘোষণা করেছে। ৬৪ জেলা প্রশাসকের প্রায় সবারই স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। মধ্য আগস্টে সরকার ৮৫০ জনের বেশি স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করেছে; যাঁদের বেশির ভাগই হাসিনার পতনের পর পালিয়ে যান। তাঁদের স্থানে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এ প্রক্রিয়া খুব কমই মসৃণ ছিল। কেননা, পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এমন নিয়োগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন।
হাসিনার আমলে প্রশাসনকে শুধু রাজনীতিকরণই করা হয়নি; এখানে দক্ষতারও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। কোটা ব্যবস্থার কারণে অনেক মেধাবী নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন; অন্যদিকে ছোট ও বৃহৎ আকারের দুর্নীতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে; হাসিনার আমলে এ পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে অনেক প্রশংসনীয় কাজ করেছে।
নিরাপত্তা খাত :
যেসব প্রতিষ্ঠান সংস্কার করতে গিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা নিরাপত্তা খাত, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার। ২০০৯ সালে হাসিনা ক্ষমতায় এলে ক্রাইসিস গ্রুপ পুলিশ বাহিনীর সংস্কারকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল; এরপরও পুলিশ ছিল ‘রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের একটি হাতিয়ার ও পৃষ্ঠপোষকতার (অন্যায় কাজকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার) একটি উৎস।’
হাসিনার পরবর্তী শাসনামলগুলোতে বিষয়টি আরও খারাপ হয়ে ওঠে। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন কর্মকর্তার ভাষায়, হাসিনা পুলিশকে তাঁর ‘আক্রমণকারী বাহিনী’তে পরিণত করেছিলেন। বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগের সমর্থক, বিশেষ করে দলটির ‘গুন্ডা’ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের কর্মীদের দিয়ে এ বাহিনীকে পূর্ণ করা হয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হাসিনা যে পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করেছিলেন, জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভে সেটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনেকটাই শান্তিপূর্ণভাবে এ বিক্ষোভ শুরু হলেও পুলিশ তা নস্যাৎ করতে প্রাণঘাতী সহিংসতার আশ্রয় নেয়। ওপরে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার ছিল আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের একজন কর্মকর্তা স্বীকার করেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হচ্ছে বিদ্যমান প্রশাসনকে কাজে লাগানো। এ প্রশাসন খুবই অদক্ষ। এখান থেকে কিছু পেতে বড় ধরনের সংস্কার চালাতে হবে বলে মনে করছে আইসিজি। এ প্রসঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব নেয়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, আগামী তিনমাসের মধ্যে নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার।
আমরা আশাকরি যে ছয় মাসের মধ্যে একটা টাইমফ্রেমের মধ্যে আগামী তিন মাসের মধ্যে আমরা পুরোপুরি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবো এবং পুলিশ পুরোপুরি ফাংশনাল হবে।
হাসিনার পতনের পর অনেক পুলিশ কর্মকর্তা প্রতিশোধের শিকার হওয়ার ভয়ে কাজে যোগ দেননি। এ অবস্থায় গত ১৭ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীকে দুই মাসের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই সময়ে সেনাকর্মকর্তারা গ্রেপ্তারের আদেশ জারি ও তল্লাশি পরোয়ানা কার্যকর করা এবং বেআইনি সমাবেশ করতে না দেওয়ার মতো বিভিন্ন ক্ষমতা দেওয়া হয়। তবে সেনাবাহিনীর এ ক্ষমতা কালই শেষ হচ্ছে।
সাংবিধানিক পরিবর্তন :
অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে। তা হলো গণতন্ত্র অক্ষুণœ রাখা এবং অন্য কোনো স্বৈরাচারকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ছিনতাই করা থেকে বিরত রাখতে সাংবিধানিক সুরক্ষা থাকা প্রয়োজন। তাই সংস্কারপ্রক্রিয়ায় মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের, বিশেষ করে বিচার বিভাগ ও সংসদের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার বিষয়ে। ওয়েস্টমিনস্টার ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশে এমন একটি নির্বাচনপ্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে, যেখানে সরকারের নিয়োগ করা প্রধান বিচারপতির কাঁধে দেওয়া বিশাল দায়িত্ব এবং আইনপ্রণেতাদের নিজ দলের বাইরে গিয়ে ভোট দেওয়ায় বিধিনিষেধের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া উচিত। দুই দশক ধরে বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা যুক্তিসঙ্গতভাবে চালু ছিল। সাংবিধানিক এই বিধান শেখ হাসিনা ২০১১ সালে বাতিল করেন।
এখন সাংবিধানিক সংস্কারের প্রশ্নে যে বিতর্কটি মূল হিসেবে সামনে এসেছে-বিদ্যমান সংবিধান সংশোধন করা উচিত, নাকি সংবিধান পুনর্লিখন উচিত। সরকারের ভেতরের অনেকে ও বেশ কিছু প্রভাবশালী আইনবিদের মতে, সংবিধান পুনর্লিখন করা সময়সাপেক্ষ। এতে রাজনৈতিক বিভক্তির আশঙ্কা রয়েছে। এর জন্য সম্ভবত একটি গণপরিষদ লাগবে।
তবে ছাত্রনেতাদের অনেকেই নতুন একটি সংবিধানের পক্ষে। তাঁদের যুক্তি হলো, বিদ্যমান সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণীত। ইতিমধ্যে ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে এবং এই সংবিধান দেশের মানুষের ওপর নিপীড়ন চালাতে ব্যবহার করা হয়েছে।
ছাত্রনেতাদের একজন বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাই। যাতে আর কখনোই কোনো দল বা রাজনৈতিক আদর্শ দানব হয়ে উঠতে না পারে।’ তাঁর মতে, অন্তর্বর্তী সরকারকে এই ইচ্ছাপূরণের প্রতি মনোযোগ দিবে না ভিন্ন পথে হাঁটবে তা দেখার বিষয়। কেননা, তাদের প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট এসেছে গণ-অভ্যুত্থান থেকে, ব্যালট থেকে নয়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন :
অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজ সেটি হলো একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তবে এ জন্য নির্বাচনী ব্যবস্থা চালুর দিকে মনোযোগ দিয়েছে সরকার। বিশেষ করে অনিয়মে ভরা বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের অভিজ্ঞতার পর এটা করা হয়েছে। এটা নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজানোর চেয়েও বেশি কিছু। যদিও বিএনপি চাচ্ছে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ। গত ১১ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূস নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিটির মধ্যে পাঁচটিরই কাজ হবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন।
দেশে নির্বাচন আয়োজন ও ব্যবস্থাপনায় জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ আমলারা (জেলা প্রশাসক) নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট আসনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সংবিধানের ধারা বদলের পাশাপাশি এসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন একতরফা আয়োজন করতে পেরেছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনপ্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এমন একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, যাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা আছে। সেই সঙ্গে তাদের নির্দলীয় ব্যক্তি হতে হবে। গত ৫ সেপ্টেম্বর হাসিনার করা নির্বাচন কমিশনের পাঁচ সদস্যই পদত্যাগ করেন। তাঁরা বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মেনে ৯০ দিনের মধ্যে সংসদ নির্বাচন আয়োজনের শর্ত পূরণ করতে পারছেন না তাঁরা। তাই একযোগে পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত।
নির্বাচন কমিশন ছেড়ে যাওয়া কমিশনাররা বেশ কিছু বিষয়ে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এর মধ্য রয়েছে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা। আশা করা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার কয়েক মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারবে। একই সঙ্গে নির্বাচনী সংস্কার কমিশন সংস্থাটির ক্ষমতা ও দায়িত্বে পরিবর্তনের প্রস্তাব করবে। অন্তর্বর্তী সরকার ভোটার তালিকা পর্যালোচনা করবে বলেও জানিয়েছে।
একটি মূল ইস্যু হলো এখনকার নির্বাচনী ব্যবস্থা বহাল রাখা হবে কি না। সমালোচকদের মতে, এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া দ্বিদলীয় ব্যবস্থা কার্যকর করার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিষাক্ত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। এর বিপরীতে তাঁদের যুক্তি, সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব চালু করা গেলে আরও বেশি রাজনৈতিক দলের জায়গা তৈরি হবে। জামায়াতে ইসলামী আনুপাতিক পদ্ধতিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। একজন ছাত্রনেতা বলেন, আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা দরকার, যা জনগণের ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে।
আওয়ামী লীগ এখন কার্যত অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের আরেকটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাবের কঠোর বিরোধিতা করেছে। আর এটা মোটেও আশ্চর্যজনক নয়। তবে বিশ্লেষকদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত বিএনপি এই পরিবর্তন মেনে নিতে বাধ্য হতে পারে। তাঁদের একজন বলেন, ‘হ্যাঁ, বিএনপি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে এই পরিবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া দলটির জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। এখন দেখার পালা অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপির ইচ্ছাকে গুরুত্ব দেয় না জামায়াতসহ অধিক রাজনৈতিক দলের প্রস্তাবকে সমীহ করে।
নোবেল বিজয়ীর নেতৃত্বাধীন সরকার গতকাল পার করলো ১০০ দিন। নিশ্চয়ই মানুষ সরকারের কাছে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসেব মিলাচ্ছেন এবং অনাগত দিনগুলোতে আরো মিলাবেন-এমনটাই বলছেন বিশ্লষকরা।