অন্তর্বর্তী সরকারের শত দিন : বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় হতাশা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ৯:৫১:০২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : ছাত্র-গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন থেকে ১০২ দিন আগে যাত্রা শুরু করেছিল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তী সরকার। গণঅভ্যুত্থানের ঠিক তিন দিনের মাথায় গঠিত সরকারের প্রতি তখন সাধারণ মানুষকে সমর্থন দিতে যেমন দেখা গিয়েছিল, তেমন প্রত্যাশাও ছিল বিপুল। প্রত্যাশাগুলোর মাঝে অন্যতম ছিলো নিত্যপণ্যেরে দাম নিয়ন্ত্রণ। তবে ক্ষমতা গ্রহণের পর যে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে অর্ন্তবর্তী সরকার পড়েছে, সেগুলোর একটি হলো নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ। বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না রাখতে পারায় আওয়ামীলীগ সরকারের প্রতি মানুষের বড় ধরনের ক্ষোভ জন্মেছিল।
অগাস্টে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। সরকার মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় গত তিন মাসে বেশ কয়েকটি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। শুল্ক কমানোর তালিকায় রয়েছে আলু, চিনি, ভোজ্যতেল, চাল ও পেঁয়াজ। কিন্তু বাজারে তার প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছিল।
নতুন সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর সুদের হার বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে টাকা না ছাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে সরকার। এতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাজারে সেটার প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি।এমনকি তেল, চিনিসহ আমদানি করা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারছে না সরকার। আর পেঁয়াজ, চাল ও আলুর দাম তো লাগামহীন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত তিন মাসে, অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী বললেন, সোজা কথায় গত তিন মাসে সরকার কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় নাই।আর দ্রব্যমূল্য যে সহনীয় পর্যায়ে নেই, সেটি সরকারও স্বীকার করছে। নবনিযুক্ত খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বললেন, আমি মধ্যবিত্ত, নিজে বাজার করে খাই। আমি নিজেও মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে আছি। তিনি জানান, গত এক সপ্তাহ পর্যন্ত চালের দাম যতটুকু বেড়েছে আপাতত তা স্থিতিশীল রয়েছে, আমন ধান বাজারে এলে দাম আস্তে আস্তে আরও কমবে।
সরকার বলছে, সাম্প্রতিক বন্যার কারণে কৃষিক্ষেত্রে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটিও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শিগগিরই চালসহ সবকিছুর দাম কমে আসবে বলেও আশা করছেন তারা।সিলেটের বন্দরবাজারের একাধিক ক্রেতা এ প্রতিবদেককে বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম তো কমেইনি, বরং সবকিছুর দাম আরও বেড়ে গেছে। এরমাঝে একজন সালেহা বেগম ও তার স্বামী দু’জনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তারা বললেন, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও বাজার খরচ চালাতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাহলে এত আন্দোলন-সংগ্রাম করে হাসিনারে নামায়ে সাধারণ মানুষের কী লাভ হলো?
সিলেটের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আলু, ভোজ্যতেল, চিনি ও পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের দাম দীর্ঘদিন ধরে উচ্চপর্যায়ে রয়েছে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। এতে মানুষের কষ্ট বাড়ছে। কারণ নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও নি¤œআয়ের মানুষকে জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহে তীব্র লড়াই করতে হচ্ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মাঝারি চাল, নন-ব্র্যান্ড খোলা সয়াবিন তেল, পাম তেল, আলু, পেঁয়াজ, রসুন ও এলাচের দাম বেড়েছে।
কৃষি বিপণন বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন ৫৪টি পণ্যের খুচরা মূল্য প্রকাশ করা হয়। পরশু তাদের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে ২৮টি পণ্যের দাম বেড়েছে এবং ১৩টির কমেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা পর্যালোচনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জেলা পর্যায়ে ১০ সদস্যের একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে। কিন্তু এ টাস্কফোর্স কতটা কাজ করছে বা তাদের সক্ষমতা কি-তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, যেকোনো উদ্যোগের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার ফলাফলের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও ফলাফলের নিরিখে এখনো বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি। অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, বাজারে গিয়ে ডান্ডাবাজি করা, এই ওষুধটা রোগের চেয়েও ভয়ংকর। একটা দাম বেধে দিলাম, বাজারে গিয়ে সেই দামে না পেলে জরিমানা করলাম, ধমকাধমকি করলাম… এই মডেল কখনো কাজ করে না। মার্কেট পুলিশিং নেভার ওয়ার্কস্। তিনি আরো যোগ করেন, আগের সব সরকারই লোক দেখানোর জন্য ‘মার্কেট পুলিশিং’ করেছে। এই সরকারও সেটা করছে।