৬ মাসের মাথায় আরেক দফা বাড়লো ওষুধের দাম!
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৮:৪৬:৩৮ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : ৬ মাসের ব্যবধানে আরেক দফা বেড়েছে ওষুধের দাম। গত সেপ্টেম্বর থেকে হঠাৎ করেই প্রায় অর্ধশত জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ৫০ শতাংশের বেশি। দাম বাড়ার তালিকায় শীর্ষে আছে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, স্নায়বিক সমস্যা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাসিডিটি ও ব্যথানাশক ওষুধ।
সরকারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও ভোক্তাদের বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী দাম বাড়ায় অনুমোদন দিচ্ছে।
সম্প্রতি দাম বেড়েছে এমন একটি ওষুধের নাম টোরাক্স। কিটোরোলাক ট্রোমেথামিন গোত্রের (জেনেরিক) ব্যথানাশক এই ওষুধটি উৎপাদন করে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস। একটি প্যাকেটে ১০ মিলিগ্রামের ৫০টি ট্যাবলেট বাজারজাত করা হয়। গত আগস্টে উৎপাদন করা ওষুধটির এক প্যাকেটের দাম ছিল ৬০০ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে গত সেপ্টেম্বরে উৎপাদিত টোরাক্স বাজারজাত হয়েছে ১ হাজার টাকায়। প্রতিটি ট্যাবলেটের জন্য ৮ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে ক্রেতাকে। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। তবে এই বাড়ার হার কোনোক্রমেই ১০ শতাংশের বেশি নয়।
তবে বাজার ঘুরে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। ওষুধের দোকানি ও বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দু-একটি ওষুধ ছাড়া সব ওষুধের দামই বেড়েছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ। তাঁরা জানান, এসিআই ফার্মাসিউটিক্যালসের টেট্রাসল ২৫ শতাংশ সলিউশনের (৩০ এমএল) বোতলের দাম সম্প্রতি ৬৮ টাকা থেকে বেড়ে ১২৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। সে হিসাবে চুলকানির ওষুধটির দাম ৮৪ শতাংশ বেড়েছে।
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনক ফুসফুসের রোগ বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি)-এর জন্য ডক্সোফাইলিন গোত্রের ওষুধ ‘ডক্সোভেন’ ট্যাবলেট উৎপাদন করে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস। ২০০ মিলিগ্রামের এক প্যাকেট ডক্সোভেন ট্যাবলেটের দাম আগে ছিল ৬৫০ টাকা, এখন সেটি ৮০০ টাকা করা হয়েছে। শতাংশের হিসাবে দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ।
শ্বাসকষ্টের জন্য ব্যবহৃত উইন্ডেল প্লাস রেস্পিরেটর সলিউশনের ৩ এমএল বোতলের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকা হয়েছে। ইনসেপ্টার ফার্মার এই ওষুধের দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। একই প্রতিষ্ঠানের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টের বুটিকট (২ এমএল) নেবুলাইজার সাসপেনশন ওষুধের দাম বেড়েছে ১৩ শতাংশ।
নগরীর মেডিকেল রোড এলাকার এক ফার্মেসী ব্যবসায়ী জানান, বিভিন্ন প্রকার ওষুধের দাম বেড়েছে। গত তিন বছরে বিভিন্ন দফায় সব প্রতিষ্ঠানই ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। কোনো কোনো ওষুধের ক্ষেত্রে একাধিক বার দাম বাড়ানো হয়েছে। যাঁরা নিয়মিত ওষুধ কেনেন, তাঁরা মাসের ব্যবধানে এসে দেখছেন, ৫০ টাকার ওষুধ ১০০ টাকা হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, গত তিন মাসে যেসব ওষুধের দাম বাড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তার সংখ্যা ১০টির বেশি হবে না। এখনো অন্তত ২০টি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান অর্ধশত ওষুধের দাম বাড়ার জন্য কাগজ জমা দিয়ে রেখেছে। তবে এই মুহূর্তে আর দাম না বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ডায়াবেটিক রোগীদের ইনসুলিন হিউমুলিন এন ইনজেকশন কুইকপেন (৩ মিলি) তৈরি করে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সিজ (বিডি) লিমিটেড। এই ইনজেকশন এক প্যাকের (৫টি) দাম ৩ শতাংশ বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া ইনজেকশন হিউমুলিন আর কুইকপেনের (৩ মিলি ) দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮৯০ টাকা করা হয়েছে। অপসোনিন ফার্মার তৈরি অ্যাসিডিটির ওষুধ ফিনিক্স (২০ এমজি)-এর দাম ১৪ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
একইভাবে বেড়েছে উচ্চ রক্তচাপের কাভারসিল ও বাইজোরানের দাম। ঠান্ডা-জ্বরের ওষুধের দামও সমানুপাতিক হারে বেড়েছে। ২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে এসব ওষুধের। বিভিন্ন গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের ক্ষেত্রেও দাম বাড়ানো হয়েছে। কোনোটির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ আবার কোনোটির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. আবদুর রাজ্জাক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে গিয়ে মানুষের আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার (নিজ পকেট থেকে বাড়তি ব্যয়) বেড়েছে। এর বড় অংশ ব্যয় হচ্ছে ওষুধে। বাংলাদেশে ৭০ শতাংশের ওপর আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার। এই ব্যয় কমাতে হলে ওষুধের ব্যয় কমাতে হবে। উৎপাদন খরচ বাড়তেই পারে, তবে তাতে দাম কত বাড়বে? মেডিসিন মানুষকে কিনতেই হয়। আয় বাড়েনি তবে ওষুধের ব্যয় বাড়লে অন্যান্য খাবারের খরচ কমিয়ে দিতে মানুষ বাধ্য হয়। এতে দেখা যায় মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে এবং অসুস্থই থেকে যায়।’
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, দেশীয় চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। আর ইউরোপ ও আমেরিকার অঞ্চলসহ সারাবিশ্বের ১৫৭টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত ওষুধ। সর্বশেষ হিসাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনুমোদিত রপ্তানি আয় ৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকার বেশি। দেশ ২২৯টি চালু অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানসহ ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক ও হারবাল ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭৩৩টি। অ্যালোপ্যাথিক প্রায় ৩ হাজার জেনেরিকের ৩৭ হাজার ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে দেশে।
ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকরী ভূমিকা নেই বলে জানিয়েছেন ওষুধ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, দেশে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের যে তালিকায় ২১৯টি ওষুধ রয়েছে, এর মধ্যে ১১৭টি ওষুধের দাম ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নির্ধারণ করে দেয়। ১১৭টি ওষুধের মধ্যে ৫৩টি ওষুধের দাম দুই বছর আগে বাড়িয়েছিল সরকার। বাকি অত্যাবশ্যকীয় এবং সব ধরনের ওষুধের ক্ষেত্রেই উৎপাদক প্রতিষ্ঠান যে দামে বাজারজাত করতে চায়, তাতে অনুমোদন দেয় অধিদপ্তর। এদিকে অত্যাবশ্যকীয় তালিকার সব ওষুধ উৎপাদনের জন্য দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে ওসব ওষুধে লাভের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি অজুহাত দেখিয়ে বেশির ভাগই প্রস্তুত করে না প্রতিষ্ঠানগুলো।