জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ১০-১২ টাকা কমানো সম্ভব : সিপিডির গবেষণা
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮:৪৬:৫৮ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক : জ্বালানি তেলের দাম বাজারভিত্তিক হলে এবং বিদ্যমান বাজার ব্যবস্থার সংস্কার করা হলে এখনই প্রতি লিটারে ১০ থেকে ১২ টাকা কমানো সম্ভব বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
তারা বলেছে, জ্বালানি তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয়ে সরকারের তৈরি সূত্র সংশোধন করা প্রয়োজন। এতে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ আছে। ‘বাজারভিত্তিক জ্বালানির দাম নির্ধারণ: সরকারি উদ্যোগ ও সম্ভাব্য সংশোধন’ শীর্ষক এক সংলাপে বৃহস্পতিবার সিপিডি এ তথ্য জানায়। রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত জানানো হয়, জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাধ্যমে দাম নির্ধারণের সূত্র তৈরি করা যেতে পারে।
অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা সহযোগী হেলেন মাশিয়াত প্রিয়তী ও প্রোগ্রাম অ্যাসোসিয়েট ফয়সাল কাইয়ুম। মূল প্রবন্ধে বলা হয়, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কীভাবে মূল্য নির্ধারণ করে তা স্পষ্ট না। এক্ষেত্রে বিইআরসিকে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করার দায়িত্ব, কর্তৃত্ব বা মূল্য নির্ধারণ মডেল তৈরি করার আইনি কাঠামো দেয়ার প্রস্তাব দেয় সিপিডি।
তারা বলছে, বিইআরসি গণশুনানির মাধ্যমে ভোক্তার মতামত নেবে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি দাম নির্ধারণ নীতিমালা দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। সিপিডি বলছে, প্রতিযোগিতামূলক দাম নির্ধারণ করতে চাইলে গ্রাহকের স্বার্থের বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। জ্বালানি তেলের দাম গ্রাহকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা প্রয়োজন। পাশাপাশি মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্য বৃদ্ধি পেলে পরে তা সমন্বয় করা যেতে পারে। মূলপ্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) কোন মডেল বা কোন আইনে জ্বালানির দাম নির্ধারণ করে তা পরিষ্কার নয়। দাম নিয়ে ভোক্তাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। ২০১৫ সাল থেকে তারা ভর্তুকি পায় না, কেননা তারা মুনাফা করে। জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়িয়ে ক্ষতি সমন্বয় করে।
মূল প্রবন্ধে সিপিডি জানায়, বাজারভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানদন্ডে মূল্য নির্ধারণ হলে ডিজেলের দাম লিটারে সাড়ে ১০ টাকা, কেরোসিনের দাম আট টাকা ১০ পয়সা, পেট্রোলের দাম ১১ টাকা ৩২ পয়সা ও ফার্নেস অয়েলের দাম ৭১ পয়সা কমানো সম্ভব।
অনুষ্ঠানে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের সূত্র তৈরি নিয়ে বিইআরসি কাজ করবে। বিআইসির মাধ্যমে দাম নির্ধারণে কোনো জটিলতা থাকার কথা নয়। সরকার এ খাতে ভর্তুকি দিতে চাইলে, সেটিও বিইআরসির মাধ্যমে দিতে পারবে। এ ছাড়া প্রতিটি কোম্পানির বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৃতীয় পক্ষ দিয়ে যাচাই করতে পারে বিইআরসি। সরকারি কোনো কোম্পানি তো মুনাফা করার কথা নয়। তারা খরচ বুঝে আয় করবে।
বিপিসি চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, সব খরচ বিপিসির নিয়ন্ত্রণে নেই। শুল্ক, কর সরকারের হাতে। তবে জ্বালানি তেলের আমদানি মূল্য বিপিসি কমাতে পারে। ইতোমধ্যে এটি কমানো শুরু হয়েছে। মজুতের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে সরবরাহকারীদের সঙ্গে দরকষাকষি আরও বাড়ানো যাবে। এ ছাড়া খরচ কমাতে চুরি, অপচয় কমাতে হবে। বাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানি তেলের দাম স্বয়ংক্রিয় সমন্বয়ের কোনো বিকল্প নেই, সরকার সেটি শুরু করেছে।
তবে বাজারভিত্তিক দাম নির্ধারণে বিরোধিতা করেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম।
তিনি বলেন, বিইআরসির কাছে না দিয়ে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ সরকারের হাত রাখতে জ্বালানি উপদেষ্টার সিদ্ধান্ত হতাশ করেছে। দ্রুত বিধিমালা জারি করে এটি বিইআরসির হাতে দিতে হবে। না হলে এলপিজির মতো এটিও আদালতের মাধ্যমে বাধ্য করা হবে। জ্বালানি তেল থেকে প্রতিবছর ১৩-১৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব নেয় সরকার, বিপিসিও মুনাফা করে। এটা সরকারের স্ববিরোধিতা।
অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম আরও বলেন, ‘বিগত সরকারের সঙ্গে তেলের দাম নিয়ে আলোচনা আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। গত সরকার জ্বালানির দাম নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে করত। এখনকার সরকারের অন্য কোনো স্বার্থ নেই। এ কারণে তেলের দাম নির্ধারণে জনগণের স্বার্থটাই বিবেচনা করা উচিত।’ খাদ্যের মতো জ্বালানি নিশ্চিত করাও সরকারের মৌলিক দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিপিসি জ্বালানি থেকে ১৩-১৪ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে। সরকার একইসঙ্গে মুনাফা ও ট্যাক্স নিয়ে থাকে। এটা সরকারের কাজ নয়।
শামসুল আলম বলেন, জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে মিটিং করা হয় সিঙ্গাপুর, দুবাইয়ে। এই মিটিংয়ের নামে বাড়তি খরচ করে জ্বালানির দাম নির্ধারণের ওপর চাপানো হয়।’ জ্বালানিতে ভর্তুকির কথা বলা হয়, কিন্তু কে কাকে ভর্তুকি দিচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এনার্জি প্যাকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিপার ভাইস-প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশিদ। তিনি বলেন, ‘গ্যাসের দাম ১৫ টাকা থেকে কয়েকগুণ উঠেছে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি না করে গ্যাস সরবরাহ করার কথা। কিন্তু প্রতিনিয়ত ক্ষতি হচ্ছে, তিতাস সে ক্ষতির কথা বিবেচনা করছে না। দেশের তৈরি পোশাক খাতসহ শিল্পের জন্য সঠিক নীতি ও সঠিক মূল্যে গ্যাস সরবরাহের তাগিদ দেন।’
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র এনার্জি বিশেষজ্ঞ তৌহিদ মওলা বলেন, ‘বাজারভিত্তিক মূল্য পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম যতই বাড়ুক দেশের বাজারের যেন সর্বোচ্চ ১০ শতাংশে ওপরে না হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশের বাজারে সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ কমানোর পরামর্শ দেন বিশ্বব্যাংকের এই এনার্জি বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, দেশের প্রান্তিক মানুষের কাজে ডিজেল ব্যবহার হয়ে থাকে। এ কারণে ডিজেলের দাম পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।’ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, প্রতি লিটার জ্বালানি তেলে বিপিসির ৫ শতাংশ মুনাফা ধরেও দাম কমানো সম্ভব। আর বিইআরসির মাধ্যমে দাম নির্ধারণের সূত্র তৈরি হলে দাম আরও কমে যাবে। এতে আরও বক্তব্য দেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব খালিদ আহমেদ, বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ূন রশীদ প্রমুখ।