রুশ আগ্রাসন ও ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন: ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী?
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৯:৩১:৫২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: ধীরে ধীরে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অগ্রসর হচ্ছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। যুদ্ধের এ পর্যায়ে এসে রণাঙ্গনে ক্রমাগত অগ্রগতি অর্জন করছে রুশ বাহিনী, আর ইউক্রেন পড়ছে ক্রমেই কোণঠাসা অবস্থায়। যুদ্ধ মানেই ধ্বংসযজ্ঞ, চারদিকে অশান্তি আর অস্থিরতা। পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার ধীর গতির অগ্রযাত্রা মানবিক বিপর্যয়েরও নতুন অধ্যায় উন্মোচন করছে।
সামনে মার্কিন প্রশাসনের পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে, ইউক্রেন এখন দুই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে-একদিকে রুশ আগ্রাসন প্রতিহত করা, অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরবর্তী প্রশাসনের জন্য প্রস্তুত হওয়া।
পাভলোহারদ শহরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে যুদ্ধপীড়িত গ্রাম ও শহর থেকে আসা শরণার্থীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে। শহরটি যুদ্ধের ক্রমশ অগ্রসরমান ফ্রন্টলাইন থেকে প্রায় ৬০ মাইল (১০০ কিলোমিটার) পশ্চিমে অবস্থিত।
সেখানে ৩১ বছর বয়সী আনাস্তাসিয়া বোলভিহিনা তার দুই সন্তান, আরসেনি এবং রোস্তিস্লাভকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। পরিবারের সবার প্রিয় বিড়ালটি ঘুমোচ্ছে তাদের সঙ্গে আনা সামান্য কিছু জিনিসপত্রের পাশে। তারা এসেছেন পোকরভস্ক শহরের কাছে অবস্থিত উস্পেনিভকা গ্রামের বাড়ি থেকে, যেখানে যুদ্ধের করাল ছায়া বিস্তৃত। আনাস্তাসিয়ার পরিবার যতদিন সম্ভব তাদের বাড়িতেই থাকার চেষ্টা করেছে। তবে চারদিকে বিস্ফোরণ, দোকানপাট বন্ধ এবং একে একে যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় শেষমেশ তারা বাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। সামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে দরজায় তালা দিয়ে তাঁরা রওনা হন।
আনাস্তাসিয়া বলেন, আমরা আশা করেছিলাম, যুদ্ধ আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবে এবং খুব দ্রুত শেষ হবে। দুই মাস বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট ছাড়াই থাকার পর, তিনি এখন আশ্রয়কেন্দ্রে বসে বিছানার ওপর রাখা ল্যাপটপে সংবাদ দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে এবং যুদ্ধ শেষ হবে। ‘আমি আশা করি, নতুন প্রেসিডেন্ট বর্তমানের চেয়ে ভালো হবেন’, যোগ করেন তিনি।
পাশের একটি অডিটোরিয়ামে, যেখানে হালকা আলো এবং একটি মাত্র হিটার দিয়ে গরম রাখা হচ্ছে, বৃদ্ধ শরণার্থীদের দেখভাল করছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। ক্লান্ত, নিস্তেজ মানুষজন ক্যাম্পের বিছানায় বসে বা শুয়ে আছেন, অনেকেই ভাবনার জগতে হারিয়ে গেছেন।
৮৩ বছর বয়সী ক্যাটেরিনা ক্লিমকো এসেছেন সুখি ইয়ালি থেকে, যা কুরাখোভের কাছে অবস্থিত। রাশিয়ার ক্রমাগত অগ্রসরের ফলে এই এলাকাটিও প্রায় তাদের দখলে চলে এসেছে।নিজের বাড়ি পুড়ে যাওয়ার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ওঠেন ক্যাটেরিনা। হারিয়েছেন তার সবকিছু। তিনি বলেন,’ এ যেন কেয়ামত শুরু হয়েছে, তারা এত বোমা ফেলেছে’। ইউক্রেন কি এখনও জয়লাভ করতে পারবে?’ স্রষ্টাই জানেন,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন তিনি। ‘যা শুনছি, আমার হৃদয় ব্যথায় ভরে ওঠে তাতে। আমাদের এত বোমা মারা হয়েছে, অনেক মানুষ মারা গেছেন।’
ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন কি যুদ্ধের সমাধান আনবে?
রাশিয়া পরশু রাতে ডিনিপ্রোতে একটি বিশাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এই হামলার আঘাত পুরো শহরজুড়ে অনুভূত হয়েছে, এমনকি বিবিসি’র প্রতিনিধি দলকেও নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে যেতে হয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ, যেমন- অ্যাটাকমস ক্ষেপণাস্ত্র এবং ল্যান্ডমাইন সরবরাহ, ইউক্রেনকে তাদের ভূখণ্ড রক্ষায় সহায়তা করার লক্ষ্যেই নেওয়া হয়েছে। এতে কেবল ইউক্রেনের নিজস্ব অঞ্চল নয়, রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলের পরিস্থিতিও প্রভাবিত হতে পারে।
যদি ডোনাল্ড ট্রাম্প আগামী বছর এই যুদ্ধ নিয়ে আলোচনার পথে এগিয়ে যান, তবে এই অস্ত্রগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো স্পষ্টভাবে জানাননি কীভাবে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করবেন। তবে তিনি বলেছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এটি সমাধান করবেন-যা অনেকেই অতিরঞ্জিত প্রতিশ্রুতি বলে মনে করছেন। ইউক্রেনের নেতারা ট্রাম্পের পরিকল্পনার দিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা বলেছেন, ‘তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন যে তিনি সমস্যার সমাধান করবেন, তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। এটি একটি স্মার্ট পদক্ষেপ।’ কুলেবা বলেন, ট্রাম্পকে ঘিরে অনেকের ধারণা, তিনি কেবল চুক্তি করতে পছন্দ করেন এবং পুতিনের প্রতি বিশেষ প্রশংসা দেখান। কিন্তু কুলেবা মনে করেন, ট্রাম্পকে এভাবে সরলভাবে দেখা ভুল। তিনি বড় বিষয়গুলো একসঙ্গে দেখতে পারেন এবং তার সিদ্ধান্ত শুধু লেনদেনকেন্দ্রিক হবে না।
নতুন প্রশাসন গঠনের পর ট্রাম্প তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ শুরু করবেন। কুলেবার মতে, তার প্রধান লক্ষ্য হবে নিজের শক্তি ও নেতৃত্ব দেখানো। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রমাণ করতে চাইবেন যে তিনি এমন সমস্যার সমাধান করতে পারেন, যা তার পূর্বসূরি করতে ব্যর্থ হয়েছেন’। তবে কূলেবা তিনি নিশ্চিত, ইউক্রেন থেকে পিছু হটার কোনো পরিকল্পনা ট্রাম্পের নেই।
যতটা আফগানিস্তানের পতন বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতিতে বড় ধাক্কা দিয়েছিল, ট্রাম্প যদি ইউক্রেনের ক্ষেত্রে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেন, তবে সেটি তার জন্য ‘আফগানিস্তান’ হয়ে দাঁড়াবে, এবং ফলাফলও হবে একই রকম। আমি মনে করি না, ট্রাম্প এমন কিছু চান,’ মন্তব্য করেছেন একজন বিশ্লেষক।
গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ২০২৫ সালে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চান তারা। তবে তিনি আরও যোগ করেন, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে থাকলে যুদ্ধ দ্রুত শেষ হতে পারে। এ মন্তব্যে ছিল জেলেনস্কির চিরচেনা কৌশল-এক দিকে প্রশংসা, অন্য দিকে চাপ প্রয়োগ।