চট্টগ্রামের উত্তাপ দেশজুড়ে
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ৯:৪৮:৫৬ অপরাহ্ন
~আইনজীবী হত্যাকারীদের গ্রেফতারে আলটিমেটাম ~ পদক্ষেপ জানতে চান হাইকোর্ট, আজ জানাবে রাষ্ট্রপক্ষ ~ ভারতের বিবৃতি ‘অনধিকার চর্চা’-উপদেষ্টা নাহিদ
জালালাবাদ রিপোর্ট : চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আইনজীবীদের সঙ্গে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর অনুসারীদের সংঘর্ষ, এ সময় আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার উত্তপ্ত ঢেউ যেন বইছে দেশজুড়ে। আইনজীবী হত্যার প্রতিবাদে সিলেট, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। ওই আইনজীবীর জানাযায় লাখো মানুষের সমাগম হয়েছে। এসময় সমন্বয়ক আইনজীবী হত্যাকারীদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতারের আলটিমেটাম দিয়েছেন। এই প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পদক্ষেপ জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।
আইনজীবী হত্যাকান্ডে জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি :
চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যাকান্ডে জড়িতদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি ইসকন নিষিদ্ধেরও দাবি জানান। হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, আমাদের দেশে সব ধর্মের সহাবস্থান থাকবে। আমরা সবার অধিকার রক্ষায় কাজ করব। কিন্তু ধর্মের দোহাই দিয়ে উগ্রবাদী সংগঠন পরিচালনা করলে বাংলাদেশে এক হাত জায়গাও দেওয়া হবে না। আমার ভাই সাইফুলকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। এই ইসকনকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে নিষিদ্ধ করতে হবে।
বুধবার চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস মোড়ে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যার প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিয়ে এ কথা বলেন হাসনাত আবদুল্লাহ। এ সময় তিনি ‘এই ইসকন জঙ্গি, তারা স্বৈরাচারের সঙ্গী’ বলে স্লোগান দেন।
বেলা সাড়ে ১১টায় নগরের জামিয়াতুল ফালাহ জামে মসজিদে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামের দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম। এরপর তাঁদের নেতৃত্বে প্রায় এক হাজার মানুষ টাইগার পাস মোড়ে অবস্থান নেন। তাঁরা ইসকনকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধের দাবিতে স্লোগান দেন। সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে হাসনাত আবদুল্লাহর পাশাপাশি বক্তব্য দেন জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রাসেল আহমেদ, কেন্দ্রীয় সহসমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ প্রমুখ। তাঁরা সবাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকা-ে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের দাবি করেন।
হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, আমরা ভুলে যাইনি, কীভাবে এই ইসকন স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের সহায়তায় ভারতের প্রেসক্রিপশনে বাংলাদেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। ভারতে বসে যতই ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করা হোক, আমরা বাংলাদেশের মানুষ সেই ষড়যন্ত্র রুখে দেব। বিদেশে বসে এই আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শক্তি দেশকে অশান্ত করার জন্য ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। আমরা বলে দিতে চাই, আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন এই বাংলাদেশে হবে না।
চিন্ময় ইস্যুতে ভারতের বিবৃতি এবং সরকারের অবস্থান :
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ভারত। তবে এটিকে ভারতের ‘অনধিকার চর্চা’ বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বুধবার তিনি বলেন, আমরা মনে করে করি, এই ধরনের স্টেটমেন্ট দেওয়া ভারতের অনধিকার চর্চা। এখানে তারা ঘটনাকে আরো উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছে। ভারতের উচিৎ তার নিজের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিতে কাজ করা।
এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে দেয়া বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ২৬ নভেম্বর মিডিয়ার কাছে দেয়া ভারতের বিবৃতির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। অতিশয় হতাশা ও গভীরভাবে অনুভূতিতে আঘাতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার উল্লেখ করছে যে, শ্রী চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে নির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর থেকে কিছু মহল তা নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার জানাচ্ছে যে, এমন অপ্রমাণিত বিবৃতি শুধু সত্যের অপলাপই নয়, একই সঙ্গে তা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও বোঝাপড়ার চেতনার পরিপন্থি।
পদক্ষেপ জানতে চান হাইকোর্ট :
ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যম আসা প্রতিবেদন উপস্থাপন করে এক আইনজীবী আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ প্রার্থনা করেন।বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে বুধবার সকালে এই আরজি জানান আইনজীবী মো. মনির উদ্দিন।এমন প্রেক্ষাপটে আদালত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামানের বক্তব্যও শোনেন। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষকে আজ বৃহস্পতিবার অগ্রগতি জানতে বলা হয়েছে।এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তানিম খান ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মুজাহিদুল ইসলাম শাহীন উপস্থিত ছিলেন। আইনজীবী মনির উদ্দিন বলেন, ইসকন নিষিদ্ধ করা এবং চট্টগ্রাম, দিনাজপুর ও রংপুরে আপাতত ১৪৪ ধারা জারির আরজি জানিয়েছেন তিনি।
এ বিষয়ে পরে নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ইসকন নিয়ে একজন আইনজীবী দুটি পত্রিকায় আসা প্রতিবেদন আদালতের দৃষ্টিতে আনেন। স্বতঃপ্রণোদিত রুল ইস্যুর প্রার্থনা করেন। তাঁর প্রার্থনার মূল প্রতিপাদ্য-ইসকনকে যেন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যাতে নির্দেশ দেওয়া হয়, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এ ঘটনা তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা হয়। ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা, অন্তত আগামী দুই সপ্তাহ।
এ পরিস্থিতিতে আদালত আইনজীবীকে ডেকে পাঠান জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আদালতের সামনে তিনি বলেন, ইসকনের ইস্যুটা দুর্ভাগ্যজনক। যে আইনজীবী এটা এনেছেন, তাঁর হৃদয়ে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, এই রক্তক্ষরণ বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের হৃদয়ের। এটা অনাকাঙ্খিত ঘটনা। এ ঘটনা ফৌজদারি অপরাধ। সরকার গুরুত্বসহকারে এ ঘটনাকে দেখছে, যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেবে।অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এই সংগঠন রেজিস্টার্ড (নিবন্ধিত) কি না, এই সংগঠন নিষিদ্ধ হবে কি না, কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে-এগুলো সরকারের পলিসি ডিসিশন (নীতিগত সিদ্ধান্ত)। সরকার এটার খোঁজখবর নিয়ে যথাযথ আইনিভাবে দেখবে। সবকিছু আদালতের সামনে এসে সুয়োমোটো নিষিদ্ধ করতে হবে-এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে আপনাদের (আদালতের) জুডিশিয়াল রিভিউর অ্যাকশন যাওয়া উচিত নয় বলে মনে করি। এটা সাংবিধানিক আইনের সঙ্গে কতটুকু যাবে, তা আমাদের বিবেচনা করতে হবে। এ কারণে এটা প্রয়োজন মনে করছি না। এটা প্রিম্যাচিউর। দেখেন, সরকার কী করছে। সরকার কীভাবে হ্যান্ডেল করছে। সব পর্যালোচনা করে তারপর যদি হয়, তখন প্রোপার ওয়েতে এলে দেখা যেতে পারে।…আদালত বললেন, কতটুকু প্রোগ্রেস আছে, কাল সকালে জানাতে। আমি জানাব।
বিকেলে যোগাযোগ করা হলে আইনজীবী মনির উদ্দিন বলেন, ইসকন নিষিদ্ধ ও চট্টগ্রামের ঘটনাসহ সার্বিক বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষকে জানাতে বলা হয়েছে।
৩ মামলা পুলিশের :
সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীকে কারাগারে পাঠানোর সময় চট্টগ্রামে সহিংসতার ঘটনায় তিনটি মামলা করেছে পুলিশ।মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (মিডিয়া) কাজী মো. তারেক আজিজ তিনি বলেন, আদালত প্রাঙ্গণ, রঙ্গম সিনেমা হল ও কোতয়ালি মোড়ে তিন জায়গায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মামলাগুলো করা হয়েছে। এসব মামলায় মোট ২৮ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে আদালত প্রাঙ্গণে হামলার ঘটনায় মামলায় ৪৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৬০০/৭০০ জনকে, রঙ্গম সিনেমা হলের সামনের ঘটনায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে ৩০০/৪০০ জনকে অজ্ঞাত এবং কোতয়ালি মোড়ের ঘটনায় ১৩ জনকে আসামি করে অজ্ঞাত আরও ২৫০/৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আইনজীবী হত্যাকারীদের ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত :
চট্টগ্রামে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) সাইফুল ইসলাম হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক ৬ জনকে ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে বুধবার এক ফেসবুক পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ফেসবুক পোস্টে বলা হয়, হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন অন্তত ছয়জনকে আটক করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে এই ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। মঙ্গলবার সংঘর্ষ চলাকালে ভাঙচুর ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে ২১ জনকে আটক করেছে সিএমপি। বন্দরনগরে ককটেলসহ আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।