নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে কৌতুহল : চালু হচ্ছে ‘না ভোট’!
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ৯:৪০:১২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : রক্তঝরা ছাত্র-গণঅভূত্থানের পর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় একটি ‘বিতর্কহীন নির্বাচন’ উপহার। এ লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে কমিশন। দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে অংশীজনের মতামত নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকগুলো প্রস্তাবনা কমিশনের কাছে জমা পড়েছে।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারে কি থাকছে এ নিয়ে কৌতুহল রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের কাছেও। বিভিন্ন সূত্র ও গণমাধ্যম বলছে, সংস্কারে সর্বাগ্রে গুরুত্ব পাচ্ছে ‘বিনা ভোটে’ যাতে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ না থাকে। একইসাথে সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা, আনুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন ও ‘না’ ভোট।
সবগুলো সমন্বিত করে একটি প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেবেন কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। এটি ডিসেম্বরের মধ্যেই হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদারও জানিয়েছেন, অংশীজনের মতামত নিয়ে নিজেদের মধ্যে বসে চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হবে।
এরইমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার সংস্কারে কি থাকছে আর কি থাকছেনা তা কিছুটা খোলাসা করেছেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি জানিয়েছেন, একক প্রার্থী থাকলেও ভবিষ্যতে বিনা ভোটে জয়ী হওয়ার সুযোগ থাকবে না। এক্ষেত্রে ‘না ভোট’ চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একজন প্রার্থী থাকলেও নির্বাচন করে বিজয়ী হতে হবে। কারণ অন্য কোনো প্রার্থী না থাকলে এ ক্ষেত্রে ‘না ভোট’ই একজন প্রার্থীর ভূমিকায় থাকবে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশকে সমৃদ্ধ করছে। কিন্তু তাঁরাই ভোট দিতে পারেন না। এ জন্য প্রবাসীদের কীভাবে ভোটের আওতায় আনা যায়, এ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী, ভোট গ্রহণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, সাংবাদিকসহ অনেকে ভোট দিতে পারেন না। তাঁদেরও কীভাবে ভোটের আওতায় আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করছি আমরা।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, আমরা সামনে পোস্টাল ভোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছি। যাঁরা পোস্টাল ভোট দেবেন, তাঁরা আগেই আবেদন করবেন। অনলাইনের পাশাপাশি উপজেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকেও পোস্টাল ভোটের আবেদনের ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশে আইনগতভাবে পোস্টাল ভোট চালু আছে, কিন্তু কার্যকারিতা নেই। আমরা এই ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না রাখার বিষয়ে আলোচনা চলছে বলে জানান তোফায়েল আহমদ। তিনি বলেন, এ নির্বাচনে দলীয় প্রতীক না থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে। আমরা এই বিষয়টি নিয়েও কাজ করছি।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে একজন নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা মানেই তিনি ভোটার। তবে কেউ মারা গেলে তালিকা হালনাগাদ করতে হবে। এজন্য এনআইডিতে কোনো ত্রুটি থাকলে সেটাকে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া হবে।
এদিকে, সংস্কার কমিশন আরো অনেক বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে ও প্রস্তাব এসেছে বলে জানা গেছে। এরমধ্যে রয়েছে-
সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন : গত কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা উঠে এসেছে। তার মধ্যে অন্যতম রাষ্ট্রপতি পদে সরাসরি ভোটে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রপতি হতে হবে দলনিরপেক্ষ। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রার্থী হিসেবে কাউকে মনোনীত না করে ভোটের মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে হবে।
নির্বাচন কমিশন গঠনে নতুন পদ্ধতি : আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনা ছিল পূর্বের সরকারের ত্রুটিপূর্ণ আইন সংশোধন করে নির্বাচন কমিশন গঠনে নতুন পদ্ধতি চালু করা। সেখানে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে একটি কমিটি হবে। সেই কমিটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেবে। এরপর যোগ্যরা আবেদন করলে তাদের মধ্য থেকে প্রার্থী বাছাই করে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রস্তাব এসেছে। যদিও আইন তৈরীর আগেই গঠন করা হয়েছে নতুন নির্বাচন কমিশন।
প্রবাসীদের ভোট কাজে লাগানো : বিশে^র বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ৪৮ লাখের বেশি বাঙালি রয়েছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় এই প্রবাসীদের বেশির ভাগই ভোট দানের সুযোগ বঞ্চিত থাকেন। তাই এবার প্রবাসীদের ভোট কাজে লাগাতে চায় সংস্কার কমিশন। তাদের জন্য ইলেকট্রনিক ভোট পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব উঠেছে। ইমেইল বা প্রযুক্তির সাহায্যে প্রবাসীরাও যাতে সরকার গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে সেই ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব এসেছে।
রাজনৈতিক দলে গণতন্ত্রের চর্চা : কোনো এক পরিবার বা ব্যক্তির কাছে রাজনৈতিক দল যেন জিম্মি না থাকে সেজন্য দলগুলোতে গণতান্ত্রিক চর্চা প্রতিষ্ঠায় একমত পোষণ করেছেন অনেকে। দলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক যেন ভোটের মাধ্যমে হয় বা এমন কোনো পদ্ধতি চালু করা যেন একই ব্যক্তি বারবার সভাপতি থাকতে না পারে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন এক শিডিউলে করা : ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও সিটি করপোরেশন নিয়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এবং ব্যয় সাশ্রয়ী করতে এসব সংস্থায় এক শিডিউলে ভোটের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করছে সংস্কার কমিশন। এজন্য একাধিক প্রস্তাবনা এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম মেয়র পদে ভোট না করে কাউন্সিলর পদে ভোট হবে। আর নির্বাচিতরা তাদের প্রশাসনিক কাঠামো ঠিক করবেন। তাদের মধ্যে থেকে একজন মেয়র হবেন। পার্শ^বর্তী দেশে এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। আর এক শিডিউলে ভোটে ব্যয় সাশ্রয়ী হবে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ।
উপজেলায় ‘নারী ভাইস চেয়ারম্যান’ পদ তুলে দেওয়া : কমিশনের কাছে প্রস্তাবনা এসেছে উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যান থাকবে না। প্রত্যেকটি উপজেলায় ওয়ার্ড হবে। একটা উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন থাকলে ৩০টি আসন হবে। ৩০ জন নির্বাচিত হয়ে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্ধারণ করবেন। জেলা পরিষদেরও ওয়ার্ড থাকবে বেশি। তখন প্রার্থী হওয়া ও নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ বাড়বে।
সংরক্ষিত নয়, নারীদের সরাসরি ভোটে নির্বাচন : নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, নারীরা সরাসরি নির্বাচন চেয়েছেন। অনেকে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি চেয়েছেন। নারীবান্ধব নির্বাচন হতে হবে। ইসি ও ইসি কর্মকর্তাদের এক-তৃতীয়াংশ নারী হতে হবে। দলীয় কার্যক্রমে নারী ৩৩ শতাংশ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নির্বাচনী ব্যয় সংকোচন ও নারী আসন ১৫০টি করার কথা বলেছেন। কেউ কেউ ১০০টি আসনের কথাও বলেছেন। অনেকে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন চেয়েছেন।
হস্তক্ষেপ রুখে দেওয়ার বিধান : অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য কেউ যাতে হস্তক্ষেপ করতে না পারে, তেমন বিধি-বিধান চান নির্বাচন কর্মকর্তারা। কমিশনের কাছে নির্বাচনী কর্মকর্তারা বলেছেন, নির্বাচন কমিশন তো একা নির্বাচন করে না। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সব অর্গান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কাজ করে। নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে সংবিধান ও আইনে, সেই ক্ষমতা যেন পুরোপুরি প্রয়োগ করা যায়। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে যাতে নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কর্মকর্তারা কোনো ধরনের বাধাগ্রস্ত না হন, এটিও নিশ্চিত করতে হবে।