বাংলাদেশ-ভারত নতুন টানাপোড়েন
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১৯:৪৫ অপরাহ্ন
* আগরতলায় বাংলাদেশের কনস্যুলার সেবা বন্ধ * ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব, কড়া বার্তা*
* সিলেটের ৩ বন্দর-স্টেশনে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ* সীমান্তে ভারতের কাঁটাতার লাগানোর উদ্যোগ*
জালালাবাদ রিপোর্ট : শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর এমনিতেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক তিক্ততার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এরমাঝে নতুন টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। বিতর্কিত ইসকন নেতা গ্রেফতার এবং এর রেশ ধরে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও পতাকা পোড়ানোর ঘটনায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের উত্তাপ বইছে। উত্তেজনা ঢেউ আছড়ে পড়েছে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রে।
হামলার পর কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে বাংলাদেশ। তলব করা হয়েছে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আগরতলায় বাংলাদেশের কনস্যুলার সেবা। কড়া বার্তা দিয়েছেন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন উপদেষ্টা। বিক্ষোভ হয়েছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সিলেটের ৩ বন্দর-স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। অন্তরালে আরো অনেক ঘটনা ঘটছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। এ নিয়ে কূটনীতিতেও চলছে নানা সমীকরণ।
এদিকে, টানাপোড়েনের সম্পর্কে বেনাপোল, তামাবিলসহ স্থবন্দরগুলোতে যাত্রীদের চিরচেনা উপচেপড়া ভিড় নেই। ইমিগ্রেশন ও আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল প্রায় ফাঁকা। ইমিগ্রেশনে অধিকাংশ কাউন্টারের কর্মকর্তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। শ্রমিকদের তেমন ব্যস্ততা নেই। অনেকটা শঙ্কা-সংশয় নিয়ে ভারত থেকে যাত্রীরা ফিরছেন।
আগরতলায় বাংলাদেশের কনস্যুলার সেবা বন্ধ :
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার পর সেখানে কনস্যুলার সেবা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, নিরাপত্তার কারণে আপাতত আগরতলার বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে কনস্যুলার সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ফলে ওই মিশন থেকে বাংলাদেশের ভিসা সেবা বন্ধ থাকবে।
সোমবার দুপুরে আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে ওই হামলা হয়। সেখানে হামলা, ভাঙচুর, ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ভেঙে বাংলাদেশের মর্যাদার প্রতীক জাতীয় পতাকা খুলে নিয়ে পোড়ানোর নিন্দনীয় ঘটনায় এই ব্যবস্থা নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এছাড়া উগ্রপন্থীদের বিক্ষোভে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে আগরতলাসহ ভারতে বাংলাদেশের সব মিশনের নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য আগেই দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নোট পাঠানো হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কঠোর প্রতিবাদের সঙ্গে ওই নোট পাঠানো হয় বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব :
ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জরুরী তলব করা হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে তাঁকে তলব করেছে বাংলাদেশ।
মঙ্গলবার বিকেল ৪টার কিছু আগে প্রণয় ভার্মা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যান। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব এম রিয়াজ হামিদুল্লাহর দপ্তরে তাঁকে তলব করা হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে বেরিয়ে যাবার সময় ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা সাংবাদিকদের বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমুখী, এখানে কথা বলার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। এই সম্পর্ককে শুধু একটি মাত্র বিষয়ে সীমাবদ্ধ করা যায় না। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক। আমরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব।
উপদেষ্টা সাখাওয়াত ও আসিফ নজরুলের কড়া বার্তা :
পায়ে পড়ে ঝগড়া করলে বাংলাদেশের মানুষ ভারতমুখী হবে না বলে মন্তব্য করেছেন নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিতে থাকতে চাই। ওনারা (ভারত) যদি পায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চান, তাহলে বাংলাদেশের লোকজন কোনোদিন ওই দেশমুখী হবে না।
মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। এম সাখাওয়াত বলেন, ভারতের প্রতি আমাদের যে একটা বন্ধুত্বসুলভ বিষয় ছিল, সেটি খারাপ করছেন ওনারা। তাদের কোনও কারণ নেই, এসব করার।
ভারতে সহকারী হাইকমিশনে আক্রমণের বিষয়ে প্রশ্ন করলে এম সাখাওয়াত বলেন, আমাদের দেশে যারা অন্য ধর্মাবলম্বী আছেন, তারা আমাদের নাগরিক। তাদের ভালো-মন্দ সবকিছু দেখছি। বিভিন্ন মিডিয়া যদি এ ধরনের প্রচার করতে থাকে, আর কেউ যদি ধমকি দিয়ে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ওপর হুমকি দেয়-যারা করছে তারা নিজেদের দেশে করছে, দয়া করে এগুলো করবেন না। আমরা একটা বন্ধুত্ব ভাবাপন্ন মনোভাব নিয়ে থাকতে চাই।
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা ভারতের নেইবার (প্রতিবেশী)। কিন্তু যদি বাংলাদেশকে এভাবে হেনস্তা করতে থাকে তাহলে মনে রাখবেন, ১৮ কোটি মানুষের এই দেশ। অন্য ছোটখাটো দেশ আপনাদের আশপাশে যা আছে এটি তা নয়।
এদিকে, আইন ও বিচারবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সোমবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এ বিষয়ে একটি পোস্ট করেন। আসিফ নজরুল লিখেছেন, ভারতকে বলি, আমরা সমমর্যাদা আর সমানাধিকার ভিত্তিক বন্ধুত্বে বিশ্বাসী। শেখ হাসিনার সরকার বিনা ভোটে ক্ষমতায় থাকার লোভে ভারত-তোষণ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তবে ভারতকে বুঝতে হবে, এটা শেখ হাসিনার বাংলাদেশ নয়। এই বাংলাদেশ স্বাধীন, সার্বভৌম ও আত্মমর্যাদাশীল। এই বাংলাদেশ নির্ভীক একটি তরুণ সম্প্রদায়ের।
সিলেটের ৩ বন্দর-স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ :
ভারতের লোকজনের বাধা ও পণ্য পরিবহন জটিলতায় সিলেটের স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তবে যাত্রী পারাপার স্বাভাবিক রয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল থেকে শেওলা স্থলবন্দর ও জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে কোনো পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেনি।
এর আগে সোমবার জকিগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে কিছু কমলা আমদানি হলেও আর কোনো পণ্য আমদানি বা রপ্তানির খবর পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে, পাথরবাহী ট্রাকে কাদামাটি ও আবর্জনা এবং ‘ওয়েট স্কেলে’ ওজন জটিলতার কারণে ১৬ দিন ধরে সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে পাথর-কয়লা আমদানি বন্ধ রয়েছে। সব মিলিয়ে সিলেটের দুটি স্থলবন্দর ও একটি শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তবে সিলেটের ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে পাথর আমদানি স্বাভাবিক আছে।
তবে ভারতের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধের বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়নি। ভারত থেকে পণ্য না আসায় বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সীমান্তে সতর্ক বিজিবি :
সীমান্তে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কিংবা অপতৎপরতা রোধে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সতর্ক রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। মঙ্গলবার দুপুরে বিজিবি সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক খুদে বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।
বিজিবি জানায়, সীমান্তে যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি কিংবা অপতৎপরতা রোধে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সতর্ক বিজিবি।
সীমান্তে ভারতের কাঁটাতার লাগানোর উদ্যোগ :
বাংলাদেশ ও ভারতে চলমান উত্তেজনার মধ্যে এবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উত্তরবঙ্গ এলাকার ৮ জেলার বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে ভারত।
সোমবার শিলিগুড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) উত্তরবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের আইজি সূর্যকান্ত শর্মা এসব কথা বলেন।
আইজি সূর্যকান্ত শর্মা বলেন, উত্তরবঙ্গের আট জেলার বাংলাদেশ সীমান্তে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাঁটাতারবিহীন এলাকায় কাঁটাতার লাগানোরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, উত্তরবঙ্গের ৮ জেলায় রয়েছে ১ হাজার ৯৩৭ কিলোমিটার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত। সেই সীমান্তের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। থার্মাল ক্যামেরা, নাইটভিশন ক্যামেরা, সিসিটিভি ক্যামেরা ও ড্রোনের সাহায্যে নজরদারি চালানো হচ্ছে। সীমান্তের ভারতীয় অংশের চেকপোস্টে বসানো হচ্ছে বায়োমেট্রিক লক।
ভারতীয় দূতাবাস এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার :
ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি নামের একটি সংগঠন। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ভারতীয় দূতাবাস এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরের পর থেকে ভারতীয় দূতাবাসে প্রবেশের বিভিন্ন রাস্তায় অবস্থান নিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিশেষ করে রাজধানীর শাহজাদপুর বাঁশতলায় ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখা গেছে। বাঁশতলা থেকে ভারতীয় দূতাবাসগামী রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগ। দূতাবাসের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর সদস্যও রয়েছেন।