রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ : স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে সবাই এক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯:১১:০৮ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট :
চলমান বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সংলাপে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই এক, সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য রয়েছে।
সংলাপের শুরুতে জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নে রাজনৈতিক মতাদর্শ পাশে রেখে সবাইকে একজোট হওয়ার আহবান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেছেন, অভ্যুত্থান যাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটিকে মুছে দিয়ে আগের ব্যবস্থায় ফেরার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
সংলাপের মূল সুর ছিলো আমাদের মধ্যে মত, পথ, আদর্শের ভিন্নতা থাকবে কিন্তু দেশ, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে আমরা সবাই এক। সবার ওপরে দেশ এবং এটা থেকে আমরা কখনো বিচ্যুত হবো না। বাংলাদেশকে দুর্বল, শক্তিহীন, নতজানু ভাবার কোনো অবকাশ নেই, এই বার্তা প্রকাশ করতে, এই বার্তা জানিয়ে দিতে বলা হয়েছে।
বুধবার বিকেলে ঢাকার বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠকটি শুরু হয়। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আসতে শুরু করেন।
সংলাপে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
এক. ভারতসহ সারা বিশ্বে যে প্রপাগান্ডা চলছে সেগুলো নিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের করণীয়; দুই. আগরতলায় সহকারী হাইকমিশন অফিস ভাঙচুর ও পতাকা অবমাননা নিয়ে করণীয় এবং তিন. বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে মিথ্যাচার সারা দুনিয়ায় চলছে, তা নিয়ে মতামত জানতে চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ সময় সরকারের পক্ষে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বৈঠকের এজেন্ডা তুলে ধরেন।
সংলাপে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে আসেনি, তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচনের জন্য তাগাদা দিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তারা বলেছেন- রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে সেবার বিষয়টি সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ বিষয়ে কী করা যায় তা আলোচনায় এসেছে।
ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের পতাকা অবমাননা এবং দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের বিষয়ে আন্তর্জাতিকভাবে যে গল্প শোনানো হচ্ছে, এ বিষয়ে করণীয় কী- তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করছেন, তারা পতিত (আওয়ামী লীগ) সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত, তাদের সরিয়ে বিপ্লবের পক্ষের শক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব এসেছে। সংখ্যালঘুদের বিষয়ে একটি জাতীয় কমিশন গঠনের প্রস্তাব এসেছে। প্রোপাগান্ডা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাবলিক রিলেশন সেল করার কথা এসেছে, যেখানে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে তথ্য প্রকাশ করবে তারা।
সংলাপ শেষে সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি জানান, সাম্প্রতিক ভারতের মিথ্যাচার, আগ্রাসনসহ নানা বিষয়ে সংলাপে আলোচনা হয়েছে। দেশের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয় বলে নেতারা একমত হয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টাকে আশ্বস্ত করেছেন দলের নেতারা।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল উপস্থিত ছিল। এই বৈঠকে সবাই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব, স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন। সবাই মিলে সমাবেশের প্রস্তাব আনা হয়েছে।
সংলাপে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তা হয়তো অনেকের পছন্দ হচ্ছে না। নানাভাবে এটাকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর বাস্তবতার দিক থেকে আপনারা এগুলো দেখেছেন। আমরা নতুন যে বাংলাদেশ গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, সেটাকে ধামাচাপা দিয়ে আরেক কাহিনী তারা রচনা করার চেষ্টা করছে। সারাক্ষণ একটা রূপরেখা তারা দিয়ে যাচ্ছে। এটা যে এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে তা নয়, বিশেষ বিশেষ বড় বড় দেশের মধ্যে এটা ছড়িয়ে গেছে।
ড. ইউনূস বলেন, বিজয়ের অভ্যুত্থান যাদের পছন্দ হয়নি তারা এটা মুছে দিতে চায়। আড়াল করতে চায়। এটাকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায়। তাদের এই অবস্থান মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য এবং বাস্তবকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের সবাইকে এক জোট হতে হবে। কারণ এখানে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের বিষয় নয়, জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমরা যে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করলাম অভ্যুত্থানের মাধ্যমে, সেটাকে তারা মুছে দিতে চায়। তার আগের ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়। মুখে বলছে না। কিন্তু ভঙ্গি হলো যে, আগেরটা ভালো ছিল।
‘তাদের শক্তি এত বেশি, অর্থের শক্তি, আয়োজনের শক্তি, মানুষকে প্রলুব্ধ করতে পারছে। যে কল্পকাহিনি তারা তৈরি করছে, সেটাতে অনেকে সংশয়ে পড়ছে’, যোগ করেন প্রধান উপদেষ্টা।
এদিকে, অপপ্রচার মোকাবিলায় সরকারের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী কাজ করবে বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামির আমির ডা. শফিকুর রহমান। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপ শেষে বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমি থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান।
সংলাপের বিষয়ে জামায়াতের আমির বলেন, অপপ্রচার মোকাবিলায় আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করবো। আমরা কারও পাতা ফাঁদে পা দেব না। কারও কাছে মাথা নত করবো না, আবার সীমালঙ্ঘনও করবো না। দুই-একদিনের মধ্যে সুখবর পাবেন আশা করি।
সরকারকে সহযোগিতা করছেন জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো ছাড় নয়। সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে আমরা ঐক্যবদ্ধ।
তিনি বলেন, বর্তমানে ভারতের ভূমিকা অসহিষ্ণু। চরমপন্থা যেদিক থেকেই আসুক আমরা ঘৃণা করি। আমরা ভালো থাকলে তারাও ভালো থাকবে। আমরা ভালো না থাকলে তারা কীভাবে ভালো থাকবে?
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এ সংলাপে অংশ নেন। বিএনপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা: শফিকুর রহমান নেতৃত্বে ছিলেন দলটির নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পারোয়ার ও সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম।
এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ও মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণ সংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নূরুল হক নূর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু ও যুগ্ম মহাসচিব আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বৈঠকে অংশ নিয়েছেন।
বৈঠকে আরও অংশ নিয়েছেন ভাসানী অনুসারী পরিষদের রফিকুল ইসলাম বাবলু, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের মামুনুল হক, খেলাফত মজলিশের আবদুল বাসিত আজাদ ও জাহাঙ্গীর হোসেন, জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, এনপিপির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ প্রমুখ।
জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে ছাত্র নেতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করছেন প্রধান উপদেষ্টা। আগেরদিন মঙ্গলবার জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগের কথা জানায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। সেদিন সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক হয়। গতকাল বুধবার হয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক। আজ প্রধান উপদেষ্টা বসবেন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে।