সীমান্তে আগ্রাসী বিএসএফ : ১০ মাসে নিহত ২৩
প্রকাশিত হয়েছে : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯:০৬:৫২ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: সীমান্তে মারমুখী অবস্থান নিয়েছে বিএসএফ। গত শুক্রবার ভোরে পঞ্চগড়ের মোমিনপাড়া সীমান্তে আনোয়ার হোসেন (৩৫) নামে এক নিরস্ত্র বাংলাদেশি যুবককে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ সদস্যরা। একই দিন রাতে লালমনিরহাটের কুটিপাড় সীমান্তে গুলিতে হেলালুজ্জামান ওরফে হেলাল উদ্দিন নামে বাংলাদেশি আরেক যুবক আহত হয়ে ভারতের দিনহাটা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এর আগে গত ৪ ডিসেম্বর দুপুরে সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালাইরাগ সীমান্ত থেকে আশরাফ উদ্দিন (৬৫) নামে এক বাংলাদেশীর গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে লাশটি বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে বিএসএফ।
এভাবে সীমান্তে বছরের পর বছর ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলি ও নির্যাতনে প্রাণ হারাচ্ছেন নিরীহ বাংলাদেশিরা। ভারত বারবার প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা দিলেও সীমান্তে গুলি থামছে না। বন্ধ হচ্ছে না তুচ্ছ কারণে হত্যাকা-। পতাকা বৈঠকেই যেন সীমাবদ্ধ সমাধানের পথ।
বিশেষ করে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারসহ রাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সম্পর্কে উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে গত ৭ বছরে সীমান্তে বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ২১০ জন বাংলাদেশি নাগরিক। এর মধ্যে চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১০ মাসে অন্তত ২৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। অথচ প্রত্যেক বছর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মধ্যে মহাপরিচালক পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলনে এ হত্যাকা- বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, কিন্তু তা বাস্তবায়ন করেনি ভারত।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল ও নিজেদের খবরদারি বজায় রাখতে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হতে পারে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর তেমন কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি। ফলে এটি বন্ধ করেনি আগ্রাসী বিএসএফ বা ভারত। তবে এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- বিষয়ে বর্তমানে শক্ত প্রতিবাদ জানাচ্ছে বাংলাদেশ।
তারা আরও বলছেন, সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত শুধু চুক্তি করে সম্মতই হয়। তবে সীমান্তে হত্যা কিংবা সহিংসতা থামেনি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রতিটি দ্বিপক্ষীয় সম্মেলনে একটি অন্যতম এজেন্ডা থাকে সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টি।
কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তে ১৫ বছর বয়সি নিরীহ কিশোরী ফেলানী খাতুন বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারায় ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি সকালে। সেই ঘটনার সাড়ে ১৩ বছর পর আনোয়ারকে গুলি করে হত্যা করা হলো। মাঝে ১৪ বছর বয়সি আরেক কিশোরী স্বর্ণা দাসসহ অসংখ্য বাংলাদেশি প্রাণ হারায় মারমুখী ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফের হাতে। ফেলানী হত্যাকা-ের পর তার লাশ দীর্ঘ সময় ঝুলে ছিল কাঁটাতারের বেড়ায়। কাঁটাতারে ঝুলে থাকা ফেলানীর লাশ প্রবল আলোড়ন তুলেছিল দেশ-বিদেশে। কিন্তু এ রকম আলোড়নের পরও শাস্তি হয়নি ওই কিশোরীকে হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যের। নিজেদের আদালত তাকে খালাস দেওয়ার পর ভারতের সুপ্রিম কোর্টেও অপরাধীর কঠোর সাজা হয়নি। তবে ওই ঘটনার পর দফায় দফায় আলোচনায় সীমান্তে হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে বিএসএফ। তবে গত ১৩ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় একেবারেই উল্টোচিত্র।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই সময়ের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন গত ১৩ আগস্ট ঢাকার পিলখানায় গিয়ে বলেছিলেন, বিজিবির মতো ফোর্সকে সীমান্তে পিঠ দেখাতে বলা হয়েছিল। সীমান্তে বাংলাদেশের লোক মারে, আর বিজিবিকে ফ্ল্যাগ মিটিং করতে বাধ্য করা হয়। সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘আমি বিজিবিকে বলেছি, পিঠ দেখাবেন না। এনাফ ইজ এনাফ, আর নয়।’
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুয়ায়ী, ২০২৪ সালে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ২৩ জন বাংলাদেশি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। এর আগে ২০২৩ সালে ৩১ জন।
২০২১ ও ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৮ ও ২৩। ২০২০ সালে ৪৯ জন, ২০১৯ সালে ৪৩ জন, ২০১৮ সালে ১৪ জন, ২০১৭ সালে ২৪ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারান বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে। আসকের হিসাবে এর আগে ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল এই ১১ বছরে বিএসএফের গুলিতে বা নির্যাতনে প্রাণ হারান ৫২২ জন বাংলাদেশি। সরকারিভাবে হিসাব রাখা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতেও হতাহতের সংখ্যা কাছাকাছি।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, বিএসএফের গুলিতে যখনই কোনো বাংলাদেশি নিহত হয়, তখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাকে গরু চোরাচালানি হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়। চলতি বছরের ৫ মার্চ ঢাকার পিলখানায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) মধ্যে মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলন হয়।
৫ দিনব্যাপী ওই সম্মেলনে সীমান্তে গুলি চালিয়ে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা-আহত-আটক বন্ধের বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় বিজিবি। মূলত প্রতিবারই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার দাবি জানায় বিজিবি। আর বিএসএফ এ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়। ঢাকায় সীমান্ত সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে বিএসএফের প্রধান ফিরে যাওয়ার পর সীমান্তে আরও মারমুখী হয়ে ওঠে বিএসএফ সদস্যরা। নিয়মিত বিরতিতে চালায় হত্যাকান্ড জুলাই-আগস্টে গণআন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবতনের পর বাড়তে থাকে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা।
প্রতিবারই গুলিতে মানুষ খুনের পর বিএসএফ সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালানোর দাবি করে। তাদের দাবি, সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশিরা তাদের ওপর আক্রমণ করায় গুলি চালাতে বাধ্য হন। তবে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ কীভাবে সশস্ত্র বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে, সেই প্রশ্নের জবাব দেন না ভারতীয় বাহিনীর কর্তারা।
বিএসএফের গুলিতে বহুল আলোচিত ফেলানী হত্যার পর বাংলাদেশের দাবির মুখে ২০১৪ সালে দিল্লিতে বিএসএফ ও বিজিবির মহাপরিচালকদের বৈঠকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার বিষয়ে সমঝোতায় আসে। সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনায় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার না করার ব্যাপারে ২০১৮ সালের এপ্রিলে দুদেশের মধ্যে একটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। কিন্তু এর পরও থামছে না হত্যাকান্ড।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, সীমান্তে হত্যা বন্ধ করতে হলে বিএসএফ-বিজিবি দুই পক্ষকেই আরও সচেতন হতে হবে। বিএসএফকে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব হত্যা বন্ধে উভয় দেশের মধ্যে যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে তা কেন মাঠপর্যায়ে মানা হচ্ছে না, তার পেছনে কী ধরনের অনুঘটক রয়েছে, দুই দেশকেই তার কারণ বের করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এ ব্যাপারে শক্ত প্রতিবাদ করা, যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে।