পতিত ফ্যাসিস্টদের ষড়যন্ত্র জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করেছে : সিলেটে জামায়াত আমীর
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২:২০:১৬ অপরাহ্ন
এমজেএইচ জামিল : জামায়াতের আমীর ডাঃ শফিকুর রহমান বলেছেন, পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তির ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের ষড়যন্ত্র বিভক্তির বদলে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করেছে। তাদের সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়েছে। জামায়াত কোন অপশক্তির কাছে মাথা নত করেনি, কেবলই আল্লাহর কাছে মাথা নত করেছে। যার ফলাফল ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্টের পতন। আমরা চাঁদাবাজী-দুর্নীতি করবো না, কাউকে করতেও দিবোনা। এজন্য জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে সর্বত্র গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমরা ছাত্র-জনতার স্বপ্নের সাম্যের বাংলাদেশ গড়তে চাই।
তিনি বলেন, দীর্ঘ ১৬টি বছর আমরা অনেক ত্যাগ শিকার করেছি, আরও ত্যাগ শিকারে প্রস্তুত তবুও ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সাম্যের বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চাই। পতিত ফ্যাসিবাদী সরকার আমাদের শীর্ষ ১১ নেতৃবৃন্দের কাউকে ফাঁসি দিয়েছে ও কাউকে হত্যা করেছে। জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারী এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধেও ফাঁিসর রায় দিয়েছে। আল্লাহর ফয়সালায় তিনি জীবিত রয়েছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে ন্যায় বিচার পেয়ে তিনি মুক্ত আকাশের নিচে ফিরবেন ইনশাআল্লাহ।
তিনি শুক্রবার সকালে দীর্ঘ দেড় যুগ পর সিলেটের ঐতিহাসিক আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে সিলেট জেলা জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপরোক্ত কথা বলেন। জেলা জামায়াতের সেক্রেটারী ও সাবেক জৈন্তাপুর উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন, সহকারী সেক্রেটারী নজরুল ইসলাম ও মাওলানা মাশুক আহমদের যৌথ পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে বিপুলসংখ্যক জনশক্তি উপস্থিত ছিলেন। সকাল ১০টায় সম্মেলনের কার্যক্রম শুরু হলেও ভোর হতেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় আলিয়া ময়দান। সম্মেলন শুরুর আগেই আলিয়া মাঠ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে জন¯্রােত ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়।
সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী উত্তরের আমীর মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অধ্যাপক ফজলুর রহমান, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও সিলেট মহানগর জামায়াতের আমীর মুহাম্মদ ফখরুল ইসলাম।
জামায়াত আমীর বলেন, ২০০৬ সালে লগি বৈঠার তা-বের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বর্বর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। দীর্ঘ ১৬ বছরে তারা ইতিহাসের বর্বর ও আগ্রাসী শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে গণধিকৃত একটি দলে পরিণত হয়েছে। তাদেরকে জনগণ চায় কিনা সেটা শহীদ ও আহতদের এবং তাদের পরিবারকে জিজ্ঞেস করলেই বুঝা যাবে। পতিত ফ্যাসিবাদী শক্তি কখনো আনসার লীগ, কখনো রিক্সালীগ, কখনো চাকুরী লীগ আবার কখনো ইসকন লীগ রুপে ফিরে এসে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চেয়েছিল। তারা শেষমেষ ধর্মীয় দাঙ্গার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু দেশপ্রেমিক জনগণ ধর্ম-বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে আরো বেশী ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছে।
তিনি আরো বলেন, এই দেশ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের দেশ। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ভিন্নধর্মের নেতৃবৃন্দ যে ধরণের ঐতিহাসিক ভুমিকা পালন করেছেন সেজন্য তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করতে প্রতিবেশী দেশ সংখ্যালঘু কার্ড খেলতে চেয়েছিল। আমরা বার বার বলেছি এদেশে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর নামে আর কোন বিভক্তি চাইনা। এর প্রতিফলন গোটা বিশ^বাসী দেখতে পেয়েছে। ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের ষড়যন্ত্র বিভক্তির বদলে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করেছে।
অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- সুনামগঞ্জ জেলা আমীর মাওলানা তোফায়েল আহমদ খান, মৌলভীবাজার জেলা আমীর ইঞ্জিনিয়ার শাহেদ আলী, সিলেট জেলা নায়েবে আমীর অধ্যাপক আব্দুল হান্নান ও হাফেজ আনওয়ার হোসাইন খান, হবিগঞ্জ জেলা জামায়াত নেতা মহসিন আহমদ, সাবেক দক্ষিণ সুরমা উপজেলা চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান আহমদ, উপাধ্যক্ষ সৈয়দ ফয়জুল্লাহ বাহার, সিলেট মহানগর ছাত্রশিবির সভাপতি শরীফ মাহমুদ, শাহজালাল বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রশিবির সভাপতি তারেক মনোয়ার, সিলেট জেলা পশ্চিম ছাত্রশিবির সভাপতি মারুফ আহমদ, সাবেক ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহ আল হোসাইন, সাবেক গোলাপগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজ নজমুল ইসলাম।
আমীরে জামায়াত বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী অপশক্তির হাতে সবচেয়ে বেশী নির্যাতিত হয়েছে জামায়াত ও ছাত্রশিবির। কিন্তু আমাদের জনশক্তি অসীম ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছে। ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন- আওয়ামী লীগের পতন হলেও এক রাতেই তাদের ৫/৬ লাখ নেতাকর্মী খুন হবে। কিন্তু ৫ জনও খুন হয়নি। কারণ ৫ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের পর সারাদেশে জামায়াতে ইসলামী-ছাত্রশিবির ও শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনসহ বন্ধু প্রতিম রাজনৈতিক দল ও আলেম-উলামাগণ দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় অতন্দ্র প্রহরীর ভুমিকা পালন করেছেন। সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে পাহারা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে ইসকন সন্ত্রাসীদের হাতে আমাদের ভাই এডভোকেট আলিফ নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। তার চেহারা এতটা বিকৃত হয়েছিল যে বাবা-সন্তান কাউকে চেহারা দেখানো হয়নি। এর মাধ্যমে পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি মুসলমানদের উস্কানী দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা সবাইকে শান্ত থাকার এবং মাঠ দখলে রাখার আহ্বান করেছিলাম। তারা শান্ত থেকেছেন ও মাঠ দখলে রেখেছেন। প্রতিবেশী দেশ থেকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কথিত নির্যাতনের ভিডিও প্রচারের মাধ্যমে বিশে^র কাছে আমাদেরকে হেয় করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের হিন্দু নেতৃবৃন্দ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, আমরা ভালো আছি আমাদের ভালো থাকতে দিন।
ডাঃ শফিকুর রহমান বলেন, পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতায় গিয়ে বিডিআর বিদ্রোহের নামে ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করেছে। এরপরই জামায়াতের উপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। তখন আমরা আমাদের বন্ধু রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দকে বলেছিলাম, এক হোন আমাদের পরে কেউ রক্ষা পাবেন না। কিন্তু তখন তারা তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছেন, আমরা তাদের বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। যার ফলে দেশ দীর্ঘ ১৬ বছর স্বৈরশাসনের কবলে পড়েছিল। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাপলা চত্তরে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের উপর গণহত্যা চালিয়ে শহীদ করে উল্টো আলেম-উলামাদের বিরুদ্ধে মামলা করে নির্যাতন চালিয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের তরুণ প্রজন্ম ছাত্র-জনতা বৈষম্যহীণ বাংলাদেশ গঠন করতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। আমরা তাদের স্বপ্নের সাম্যের বাংলাদেশ গঠন করতে চাই। লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগেই তাদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করতে চাই। নারীদেরকেও তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে চাই। যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই। আমরা মানুষ, আমাদের ভুল ও ঘাটতি আছে। আমরা সেটা কাটাতে চাই। সংশোধন করে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। চরিত্রবান সুনাগরিক গঠন করতে চাই। সমাজ গঠনের আগে নিজেকে গড়তে চাই। এইকাজ শুধু জামায়াতের সদস্য-কর্মীদের নয়, জনসাধারণকে এতে সম্পৃক্ত করতে হবে। আলেম-উলামাগণ আমাদের পথ প্রদর্শক। তাদের দোয়া ও সহযোগিতা নিয়ে আমরা সাম্য শান্তির বাংলাদেশ গঠন করতে চাই।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, আমাদের তরুণ ও যুবকরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে গণঅভ্যুত্থান করেছে, তা বিশে^র বুকে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। ছাত্র-জনতার স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনে জামায়াত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ঘরে ঘরে পাড়ায়-মহল্লায় ইসলামী আন্দোলনের দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। ইনসাফভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আন্দোলনে দেশপ্রেমিক জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
মুহাম্মদ সেলিম উদ্দিন বলেন, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দেশের রাজনীতি, উন্নতি ও সমৃদ্ধিতে জামায়াত আজ এক অনিবার্য বাস্তবতার নাম। মানুষ জামায়াতকে জানতে চায়, ইনসাফভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে চায়। সেই সুযোগ করে দিতে হবে। অতীতের মতো কেউ যদি জাতিকে বিভক্ত করে ফ্যাসিবাদী হতে চায় তাদেরকেও আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পরিণতি বরণ করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে মাওলানা হাবিবুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন পর সিলেটের ঐতিহাসিক আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানের কর্মী সম্মেলনকে জনসমুদ্রে পরিণত করার জন্য সিলেটবাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমরা দুর্নীতিমুক্ত ইনসাফভিত্তিক বাংলাদেশ গঠন করতে চাই। এতে দেশপ্রেমিক জনতার অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে হবে।