সংস্কার নিয়ে কৌতুহল, অগ্রগতি কতদূর?
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:২০:০৭ অপরাহ্ন
সিলেটে আজ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের মতবিনিময়
জালালাবাদ রিপোর্ট: রাষ্ট্র ও রাজনীতি এখনো চলছে পুরনো ছকে। সেই ছক বদলাতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছে দশ দশিিট সংস্কার কমিশন। ডিসেম্বর-জানুয়ারীর মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবনা জমা দেয়ার কথা। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সংস্কার নিয়ে ব্যাপক কৌতুহল আছে। তবে নির্ধারিত সময়ে জমা দেয়া সম্ভব হবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ওদিকে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছে বিএনপি। জামায়াত তাড়াহুড়ো না করলেও একটি গ্রহনযোগ্য সময়ের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে সংস্কার কমিশনগুলোর কাজের অগ্রগতি কতদূর- সেই আলোচনা সামনে আসছে।
গতকাল শনিবারও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শিগগিরই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা আশা করি, খুব দ্রুত জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা হবে।
এর প্রেক্ষিতে গতকালই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিবিদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আমরা সরে যাবো। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, চূড়ান্তভাবে একটি নিরপেক্ষ এবং সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর। এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো সুযোগ নেই। ওদিকে, বিএনপি যখন তড়িঘড়ি নির্বাচন চাচ্ছে তখন সংস্কার প্রস্তাব চুড়ান্ত করতে কমিশনগুলোও ব্যস্ত সময় পার করছে। বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে চলছে তাদের মতবিনিময়। সিলেটেও আজ রোববার মতবিনিময়ে বসছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। যেখানে উপস্থিত থাকবেন কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারসহ সংশ্লিষ্টরা।
ডিসেম্বর-জানুয়ারীর মধ্যে সুপারিশ জমা দিতে হলে সংস্কার কমিশনগুলোর হাতে আর বেশি সময় নেই। সব কাজ গুছিয়ে সুপারিশ জমা দেওয়ার জন্য ৯০ দিন ‘স্বল্প সময়’ বলে মনে করছেন কমিশনপ্রধানদের কেউ কেউ। তবে তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন তুলে দিতে আশাবাদী। ক্ষমতাগ্রহণের দুই মাসের মাথায় অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রাষ্ট্রের ছয় খাত সংস্কারের লক্ষ্যে ৬টি কমিশন গঠন করে সরকার। এরপর নভেম্বরে আরো আরও ৪ খাত সংস্কারের জন্য ৪টি কমিশন করা হয়। প্রত্যেক কমিশনকে সুপারিশ জমা দিতে ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে।
প্রথম ধাপে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশন ওয়েবসাইট খুলে মতামত সংগ্রহ, অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়, জরিপ ও লিখিতভাবে মতামত নেওয়ার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। সুপারিশমালা প্রস্তুতে এসব প্রস্তাব ও মতামত পর্যালোচনার কাজ আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যে শেষ করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে তারা। নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে দ্বিতীয় ধাপে গঠন করা চার সংস্কার কমিশনের কাজও শুরু হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন হয় ৩ অক্টোবর। সে হিসাবে ২ জানুয়ারি শেষ হতে যাচ্ছে ৯০ দিন।
৬ অক্টোবর গঠন করা হয় সংবিধান সংস্কার কমিশন। ৫ জানুয়ারি এ কমিশনের জন্য প্রতিবেদন জমা দেওয়ার শেষ সময় ধরা হচ্ছে।১৮ নভেম্বর গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। প্রতিবেদন দিতে ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় পাচ্ছে তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া তিনটি জাতীয় নির্বাচনসহ দলীয় সরকারের অধীনে হওয়া সকল নির্বাচন নিয়ে কমবেশী বিতর্ক রয়েছে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া, ভোটকেন্দ্রে বিরোধী প্রার্থীদের বাধা, কারচুপি, দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগ উঠলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়।
এসব কারণে গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংস্দ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী দলগুলো।
২০১১ সালে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর থেকে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়ে আসছিল।আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, ২ জানুয়ারি খসড়া হালনাগাদ ভোটার তালিকা প্রকাশের পর তথ্য সংগ্রহে বাড়ি বাড়ি যাবে। এরপর ২ মার্চ চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে। গত সোমবার কমিশনের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বিএনপির পক্ষ থেকে তিন থেকে চার মাসের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের দাবি জানানো হয়।
‘বড় ধরনের সংস্কার করে নির্বাচন’-আইএমএফের এক উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এমন বার্তা দেওয়ার পর দিন বিএনপির পক্ষ থেকে ওই দাবি আসে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কতদূর এগিয়েছে এ প্রসঙ্গে কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার গণমাধ্যমে বলেন, আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সুপারিশ জমা দিতে পারব। সময় নিয়ে একটা প্রতিবন্ধকতা আছে। অনেক কাজ এবং অনেকের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। যত সময় পাওয়া যাবে তত বেশি কাজ করা যাবে, মানুষের মতামত নেওয়া যায়।
নিবন্ধিত ৪৮ দলের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতসহ ২২টির কাছ থেকে লিখিত মতামত চেয়েছিল নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। আওয়ামীলীগ ও বিলুপ্ত দ্বাদশ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ বাকি দলগুলোর কাছে মতামত চাওয়া হয়নি। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, কী সুপারিশ থাকবে এটা বলা দুরূহ, কিন্তু একটা জিনিস বলা যায়, ইভিএম থাকবে না। কারণ ইভিএম যেগুলো আছে সেগুলো কার্যকর নয়, নষ্ট হয়ে গেছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রধান আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান বলেন, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম একটা চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের কাজ খ-কালীন নয়, স্থায়ী কমিশন থাকা উচিত। দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক সংস্কারে গঠিত কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের তো ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়। আশা করছি এ মাসের শেষের দিকে সুপারিশ জমা দিতে পারব, বড়জোর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ লাগতে পারে।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ ইতোমধ্যে বলেছেন, আমাদের কাজের অগ্রগতি হচ্ছে। রাজনৈতিক দল, অংশীজনসহ সবার সহযোগিতা পাচ্ছি। নির্ধারিত সময়ে সুপারিশ দিতে পারব আশা করি। কমিশনকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী সুপারিশ করব। ৬ অক্টোবর কাজ শুরুর পর থেকে ৯০ দিন তথা ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত (প্রতিবেদন জমার) সময় পাবো আশা করি।সবশেষ ৪ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে যে ছয় কমিশন করেছে সেই সব কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। এ বৈঠকে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছেন, তার কমিশনের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সবার মতামত সংগ্রহ করছেন তারা।
গত ১৮ নভেম্বর আরো চারটি-গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদেরও প্রতিবেদন হস্তান্তরের কথা রয়েছে।স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ তিনদিন আগে একটি গণমাধ্যমে বলেন, আমরা মাত্র শুরু করলাম। সময়ের মধ্যেই দেওয়া উচিত। লোকজনের সঙ্গে বসতে হবে, শুরু করেছি আমরা। দলগুলোর সঙ্গে এখনও বসা হয়নি, তাদের থেকে সুপারিশ নেওয়া হবে। লোকজন পরামর্শ দিচ্ছে, কেমন সাড়া আসছে এবং কী ধরনের পরামর্শ আসছে তা এখন বলা সম্ভব না।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান সাংবাদিক কামাল আহমেদ বলেন, আমরা ১৮ দিন মাত্র গঠিত হয়েছি, ১৫ দিনও অফিস করার সুযোগ পাইনি। আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা করছি। তবে এখনই সংস্কার পরিকল্পনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করার সুযোগ আসেনি।
এর আগে সংবিধানে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা, উপরাষ্ট্রপতি ও উপপ্রধানমন্ত্রী পদ সৃজনসহ ৬২টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।
এদিকে, নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ‘ব্যাপক সংস্কারের’ পক্ষে মত দিয়ে জামায়াতে ইসলামী বলেছে, সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব বলে তারা মনে করে না।
নির্বাচন ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ৪১টি প্রস্তাব অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তুলে ধরেছে জামায়াত। সংবিধান সংস্কার করে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ‘ভারসাম্য’ আনার পাশাপাশি একই ব্যক্তির পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকার সুযোগ বন্ধ করার বিষয়টি রয়েছে জামায়াতের প্রস্তাবে। এছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা চালু করা, সংবিধানে ‘কেয়ারটেকার সরকার’ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে সন্নিবেশ করা এবং রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের নিয়ম বাতিল করার প্রস্তাব দিয়েছে দলটি।