সিলেট মুক্ত দিবস আজ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫:০১ অপরাহ্ন
স্টাফ রিপোর্টার: আজ ১৫ ডিসেম্বর। সিলেট মুক্ত দিবস। এদিন মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করেছিলেন সিলেটের মুক্তিকামী মানুষ। ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে সেদিন মুখর ছিল সিলেটের অলিগলি। স্বাধীনতার লক্ষ্যে সারা দেশের মতো সিলেটও ছিল ঐক্যবদ্ধ, অবিচল।
৬ ডিসেম্বর সিলেট শহরে প্রচ- বোমা হামলা শুরু হয়। এই হামলা ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। চারদিকে জ্বলছিল আগুনের লেলিহান শিখা। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল আলী আমজাদের ঘড়ি। কিন ব্রিজ হয়েছিল দ্বিখ-িত। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল বিভিন্ন নির্মাণ ও আবাসভূমি।
১৩ ডিসেম্বর দুপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল খাদিমনগর এলাকায় এসে অবস্থান নেয়। একই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের আরো কয়েকটি দল দক্ষিণ জালালপুর ও পশ্চিম লামাকাজি এলাকায় আসে। তখন ফাঁকা ছিল শুধু উত্তর দিক। কিন্তু সেদিকে সীমান্তবর্তী পাহাড়, বনাঞ্চল থাকায় হানাদারদের পালাবার কোনো পথ ছিল না। তারপর হঠাৎ একদিন নাম না জানা দু’জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা খাদিমনগর থেকে একটি গাড়িতে চড়ে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের জন্য বেশ কয়েকঘণ্টা শহরে মাইকিং করতে থাকেন। তাদের সেই মাইকিংয়ের মধ্যদিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে নতুন করে সাহসের সঞ্চার হয়। তখন সিলেট শহর ছিল পুরোদমে উত্তপ্ত।
এদিকে, মাইকিং করতে করতে সাহসী মুক্তিযোদ্ধা দু’জন ক্রমান্বয়ে শহরের দিকে আসেন। পথে পথে, বাসাবাড়ি, দোকানপাটে থাকা উদ্বিগ্ন মানুষ তাদের কণ্ঠের ধ্বনি শুনে আবেগ আপ্লুত হয়েছিলেন। বাহবা দিচ্ছিলেন সবাই। যে গাড়িতে মাইকিং চলছিল সেই গাড়ির পেছনে আরেকটি গাড়িতে করে শহরের দিকে আসছিলেন মুক্তিযুদ্ধে উত্তরাঞ্চলের (১) বেসামরিক উপদেষ্টা, তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য মরহুম দেওয়ান ফরিদ গাজী ও মিত্রবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল বাগচী। শহরের লোকজন অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তাদের যাত্রা দেখছিলেন। তখন হানাদারদের অবস্থান ছিল সিলেট সরকারি কলেজের আশপাশে। তারাও শক্ত অবস্থানের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।
ক্রমান্বয়ে তারা সংগঠিত হয়ে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু মাইকিং করার পর শত্রুরা আত্মসমর্পণের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়। এর ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদিমনগরের দিকে ফিরে যেতে হয়। ওইদিন কদমতলী এলাকায় ঘটে আরেক ঘটনা। একটি ইটখোলায় ২১ জন পাকিস্তানি সেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ৩৫ জনের মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর একটি দল। সেদিনের অপারেশনে নেতৃত্ব দেন রানা সিং নামে এক ভারতীয় সুবেদার। প্রায় ৯ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধের পর নিরুপায় হয়ে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়। এরপর শুরু হয় আরেকটি অধ্যায়। মাছিমপুর থেকে নিক্ষিপ্ত একটি শক্তিশালী মর্টার এসে আঘাত করে সুবেদার রানাকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিহত হন। আহত হন মিত্রবাহিনীর আরো দুই সদস্য। তবে তাদের নাম সেদিন জানা ছিল না কারো।
পরে ১৪ ডিসেম্বর সরকারি কলেজের আশপাশ থেকে শত্রুরা তাদের অবস্থান তুলে নেয়। ওইদিন দুপুরে দেওয়ান ফরিদ গাজী ও কর্নেল বাগচী বিনা প্রতিরোধে শুধু শহরেই নন; বিমানবন্দরের পাশে গড়ে ওঠা শত্রুদের মূল ঘাঁটির কাছাকাছি পর্যন্ত ঘুরে আসেন। ইতোমধ্যে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে ‘জেড’ ফোর্সের সেনারা সিলেট এমসি কলেজ সংলগ্ন আলুরতলে সরকারি দুগ্ধ খামারের কাছে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়। তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সবদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। ওইদিন সন্ধ্যায় চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর জওয়ানরা দলবদ্ধভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেন।মুক্তিযোদ্ধাদের কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে সিলেট শহর। পাড়ামহল্লা অলিগলি প্রকম্পিত হয়ে ওঠে তাদের পদধ্বনিতে। ‘জয় বাংলা জয় বাংলা’ স্লোগানে সরে যায় রাজাকার-আলবদরদের পায়ের তলার মাটি। অবস্থা বেগতিক দেখে তারা রাতেই গা-ঢাকা দিতে শুরু করে।
পরদিন ১৫ ডিসেম্বর সকালে সব বয়সী মুক্তিপাগল মানুষের ঢল নামে শহরে। তাদেরকে ঘিরে ভিড় জমে পথে পথে। ঘড়িতে তখনো ১২টা হয়নি। শহরবাসী মাইকের মাধ্যমে গোটা সিলেটে প্রচার করতে থাকেন ‘সিলেট হানাদারমুক্ত সিলেট হানাদারমুক্ত’। সেই থেকে ১৫ ডিসেম্বর ‘সিলেট মুক্ত দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।