আজ মহান বিজয় দিবস : নতুন স্বপ্ন , প্রত্যাশা অশেষ
প্রকাশিত হয়েছে : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩:১০:১৬ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট: আজ ১৬ ডিসেম্বর। মহান বিজয় দিবস। বিজয়ের ৫৪তম বার্ষিকী। বাংলাদেশের মানুষের হাজার বছরের শৌর্যবীর্য এবং বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় দিবস। বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশসহ পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখন্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন।
১৯৭১ সালের এদিনে বাঙালি জাতি পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। ২৪ বছরের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতির ভাগ্যাকাশে দেখা দেয় এক নতুন সূর্যোদয়। প্রভাত সূর্যের রক্তাভা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সমস্বরে একটি ধ্বনি যেন নতুন বার্তা ছড়িয়ে দেয় পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।
মুক্তি পাগল দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে বলে একদিন অস্ত্র কাঁধে তুলে নেয়। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার সবাই শরিক হয়ে থাকে এ লড়াইয়ে। যতই দিন অতিবাহিত হতে থাকে আরো শাণিত হয় প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র। লক্ষ্য স্থির রেখে শত্রু হননে দৃঢ়তায় এগিয়ে যায় বীর জাতি।
যুগ যুগ ধরে শোষিত বঞ্চিত জাতি চোখে আনন্দ অশ্রু আর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে। বিন্দু বিন্দু স্বপ্নের অবশেষে মিলিত হয় জীবনের মোহনায়। আসে কাঙ্খিত বিজয়। প্রথম আগুন জ্বলে ৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি। ফাগুনের আগুনে ভাষা আন্দোলনের দাবি আর উন্মাতাল গণমানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত একাকার হয়ে যায় সেদিন। ভাষার জন্য প্রথম বলীদান বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে। সেই থেকে শুরু হয়ে যায় এ জাতির শেকল ভাঙার লড়াই। পাকিস্তানিদের সাথে হিসেব-নিকেশের হালখাতার শুরুতেই রক্তের আঁচড় দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ শুরু করে তার অস্তিত্বের লড়াই। ৯ মাসের দীর্ঘ লড়াই শেষে অবশেষে গভীর কালো নিকষ আঁধার থেকে মানুষ পায় বিজয়ের স্বাদ। আসে নতুন প্রভাত।
সেই নতুন প্রভাত ও স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গকারী বীর শহীদদের আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে জাতি। রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধায় স্মরণ হবেন বীর যোদ্ধারা।
রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় স্মৃতি সৌধে যাওয়া, প্রথম প্রহরে তোপধ্বনি, ইত্যাদি সকল কর্মসূচিই রয়েছে আজ। এবার বিজয় দিবসকে উৎসবমুখর করতে সারা দেশে বিজয় মেলার আয়োজন করা হয়েছে। থাকছেনা কুচকাওয়াজ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, ‘বিজয় দিবস আমাদের জাতির জন্য অনন্য দিন। ৯ মাস যুদ্ধ করে জাতি এই বিজয় অর্জন করেছে। সারা দেশের মানুষ যুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিল। একসময় গ্রামে ও সারাদেশেই এই বিজয় উৎসব হতো। দীর্ঘ বছর ধরে এই উৎসব নিস্ক্রিয় ছিল। এবার সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিজয় মেলা হবে।
উপদেষ্টা বলেন, আগে যে প্রচলিত কুচকাওয়াজ হতো, এতে জনগণের সম্পৃক্ততা থাকত না, সেখানে স্কাউট ও স্বেচ্ছাসেবকরা থাকত। তার সঙ্গে অন্যান্য বাহিনী থাকত। এতে সরাসরি জনগণের সম্পৃক্ততা ছিল না। এবার শিশু, নারী, পুরুষ সব শ্রেণির জনগণকে সম্পৃক্ত করা হবে। গ্রামীণ বাংলার বিভিন্ন ঐতিহ্য নিয়ে এই মেলা হবে। এ জন্য অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।
আসলে সময়ের স্রোতে সবই যেন এবার বদলে গেছে। এবার ভিন্ন এক বাস্তবতায় পালিত হবে বিজয় দিবস। পাল্টে গেছে সরকার। পাল্টে গেছে রাজনীতি। বিজয়ের এই মহানন্দের দিনে নেই ব্যক্তিবন্দনা। ৫ আগস্টের এক রক্তঝরা বিপ্লব যেন সব চেনা চিত্রকেই পাল্টে দিয়েছে। পাল্টে যাওয়া সময়ে দেশের মানুষ এখন এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। যে দেশে থাকবেনা কোন বৈষম্য । থাকবেনা দূর্নীতি, অপশাসন ও ফ্যাসিজম। থাকবেনা রাতের ভোট, দেখা যাবেনা ডামী নির্বাচন। বিপ্লবী তরুণরা রাজনীতির চেনা ছক বদলে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়। অথচ কয়েক দিন আগেও মনে হতো, শেখ হাসিনার সরকার বোধ হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। বিপ্লবী এক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁকে সরানো গেছে। আন্দোলনের পেছনে তো জনগণের বিরাট আকাঙ্খা ও স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা হলো, আমরা এ রকম দেশ চাই না, আমরা এ রকম ভয়াবহ দুর্নীতি, নজিরবিহীন নিপীড়ন ও কণ্ঠরোধ আর দেখতে চাই না।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবসকে তাদের ক্ষমতার পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হাস্যকর অভিধায় পরিণত করেছেন। তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্সি দাবি করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই যে প্রবঞ্চনা, তার অবসান ঘটল ৫ আগস্ট। সেই কারণেই এই বিজয় দিবস নতুন স্বপ্ন ও নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে হাজির হলো। শিক্ষার্থীদের রক্তের সাগরে নতুন বাংলাদেশের এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাই প্রত্যাশাও আকাশছোঁয়া।
রাষ্ট্রের প্রতিক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ তারা উপহার দেবেন- যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকলে সমান অধিকার ভোগ করবে, রাষ্ট্রকে আপন ও নিরাপদ ভাববে। তবেই হয়তো পূর্ণতা পাবে একাত্তর ও চব্বিশের বিজয়ের আনন্দ।