দ্বন্দ্বের ঘোরাটোপে বিশ্ব ইজতেমা
প্রকাশিত হয়েছে : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:১০:২৪ অপরাহ্ন
রণক্ষেত্র তুরাগ তীর, ঝরলো ৪ প্রাণ
জড়িত কাউকেই ছাড় নয় : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা * উম্মাহর স্বার্থে সবাই শান্ত থাকুন : জামায়াত আমীর
জালালাবাদ রিপোর্ট : বেশ কিছুদিন ধরেই উত্তেজনা চলছে। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য ও বিবৃতি আসছে গণমাধ্যমে। প্রকাশ্যে এক পক্ষ অপর পক্ষকে করছে বিষেদাগার। তবে এবার আর কথার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকলোনা। রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লো বিশ্ব ইজতেমার সাদ ও জুবায়েরপন্থিরা। ঝরে গেলো চার চারটি প্রাণ। দ্বন্দ্বের এমন ঘেরাটোপে পড়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমা নিয়েই অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব ও ৭ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
ইজতেমা মাঠে হামলা ও সংঘর্ষে ৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। নিহতরা হলেন- কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া থানার এগারসিন্দু গ্রামে আমিরুল ইসলাম বাচ্চু (৭০), ঢাকার দক্ষিণ খানের বেড়াইদ এলাকার বেলাল (৬০), বগুড়ার তাজুল ইসলাম (৭০)। আরেকজনের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, হত্যাকা-ের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের ছাড় দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। এ ঘটনায় মামলা হবে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, মামলার পর জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই পক্ষের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, মঙ্গলবার দিনগত রাত ৩টার দিকে সাদপন্থীরা তুরাগ নদীর পশ্চিম তীর থেকে কামারপাড়া ব্রিজসহ বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে ইজতেমা মাঠে প্রবেশ করতে থাকে। এসময় মাঠের ভেতর থেকে যোবায়েরপন্থীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। জবাবে সাদপন্থীরাও পাল্টা হামলা চালায়। একপর্যায়ে সাদপন্থীরা মাঠে প্রবেশ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। মুহূর্তেই রণক্ষেত্রে রূপ নেয় আশপাশ এলাকা। সংঘর্ষে ৪ জন নিহত ও কয়েকশ আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। হতাহতদের গাজিপুর ও ঢাকার হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়।
এ ঘটনার পর ইজতেমা ময়দানে প্রবেশে পুলিশ নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় মুসল্লিরা ধীরে ধীরে ময়দান ও আশপাশের এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন। বুধবার বিকেলে সরেজমিনে টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানের আশপাশে এমন চিত্র দেখা যায়। ইজতেমা ময়দানে কেউ যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য দুপুরের পর সবগুলো গেট তালা দেওয়া হয়। দুপুরের আগেই বেশিরভাগ মুসল্লি ময়দান ত্যাগ করেন। তবে যারা বের হতে পারেননি তারা দেয়াল ও গেট টপকে ময়দান ছাড়ছেন। ইজতেমার ময়দানের বাইরের অনেকে আত্মীয়-স্বজনের খোঁজে এসেছেন। ইজতেমা ময়দানের আশেপাশে পুলিশ-বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। ইজতেমা ময়দানের আশেপাশে জলকামান ও রয়েট কারও মোতায়েন করা হয়েছে।
একে অপরের ওপর চাপাচ্ছেন সাদ-জুবায়েরপন্থিরা :
টঙ্গীর তুরাগ তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান দখলকে কেন্দ্র করে মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদের অনুসারিদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় দুই পক্ষই একে অপরকে দায়ী করছে। সাদপন্থীদের দাবি, কামারপাড়া থেকে স্লুইচ গেইট পর্যন্ত সড়কে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় রাত সাড়ে ৩টার দিকে জোবায়েরপন্থিরা তাদের দিকে ‘ইট পাটকেল, জলন্ত মশাল’ নিয়ে হামলা করে। অন্যদিকে জুবায়েরপন্থিরা দাবি করছেন, ইজতেমার মাঠে অবস্থানকালে রাত সাড়ে ৩টায় ‘ছুরি, ক্ষুর, হাতুড়ি, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালান সাদপন্থিরা।
সাদ অনুসারী মুফতি মু’আয বিন নূর ইজতেমা মাঠ থেকে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তাবলিগের এক পক্ষ সারা বছর এ মাঠটি ব্যবহার করে। তারা এবার যখন এ মাঠটিতে পাঁচদিনের জোড় (জমায়েত) করলেন তখন আমরা সেখানে জোড় (জমায়েত) করার অনুমতি চাই। সরকার দুই পক্ষকে নিয়ে গত ৪ নভেম্বর বসার চেষ্টা করলেও আমরা এসেছি, কিন্তু তারা আসেনি। তিনি দাবি করেন, বিভিন্ন স্থানে সাদপন্থিরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। রাত সাড়ে ৩টার দিকে কামারপাড়া থেকে স্লুইচ গেইট পর্যন্ত সড়কে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার সময় জুবায়েরপন্থিরা তাদের ওপর ইটপাটকেল ও জলন্ত মশাল নিক্ষেপ করে আক্রমণ শুরু করে। সেখান থেকেই ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে জুবায়েরপন্থিদের ধাওয়া দিয়ে সাদপন্থিরা মাঠে প্রবেশ করে।
অপরদিকে জুবায়েরপন্থিদের নেতা মুফতি আমানুল হক কাকরাইল মসজিদ থেকে সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, ইজতেমার মাঠে অবস্থানকালে রাত সাড়ে ৩টায় ‘ছুরি, ক্ষুর, হাতুড়ি, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালান সাদপন্থিরা। জুবায়েরপন্থিদের আরেক নেতা মামুনুল হক বলেন, আমাদের ৪ জন ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন। তাদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। একপক্ষীয়ভাবে হামলা হয়েছে। তাই সাদপন্থিদের ইজতেমা হওয়ার আর কোনো সুযোগ এখন নেই। এদিকে, সাদপন্থীরা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে পারবেন কি না, এমন এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, তারা দুই পক্ষ যদি আলোচনা করে সমাধান করতে পারে, তাহলে সাদপন্থীরা ইজতেমায় অংশ নিতে পারবেন। ইজতেমার তারিখ সরকার বাতিল করেনি। তারা আলোচনা করুক।
তিন কিলোমিটার এলাকায় ১৪৪ ধারা :
গাজীপুরের টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ডা. নাজমুল করিম খান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ আইন ২০১৮ এর ৩০ ও ৩১ ধারায় পুলিশ কমিশনারকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখ দুপুর ২টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্ব ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশের তিন কিলোমিটার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ এলাকায় নি¤œলিখিত আদেশ বলবৎ থাকবে।
প্রতিশ্রুতি দিয়েও সংঘর্ষে লিপ্ত :
মাওলানা জুবায়ের ও মাওলানা সাদ কান্ধলভীর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষে ৪ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। বুধবার সকালে নিজের ভেরিফাইয়েড ফেইসবুক পেইজে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, সাদপন্থী সমর্থিত ‘সচেতন ছাত্র সমাজের’ দেয়া প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি এবং সকাল ১০টার মধ্যে মাওলানা সাদ সাহেবের ভিসার জন্য বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণার কারণে আমরা অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে সাদপন্থিদের সাথে আলোচনার জন্য টঙ্গী যাই। সেখানে আলোচনা শেষে তারা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি প্রত্যাহার করেন এবং মাওলানা সাদ সাহেবের ভিসা জটিলতা নিরসনে পুনরায় আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তারা টঙ্গী ময়দানে জোড়ের শর্ত দেন এবং ২৫ তারিখ মাঠ ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দেন। টঙ্গীতে এই তিনটি বিষয়ে আলোচনা হয়। অথচ দেখা গেলো তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লেন।
দ্বন্ধ কোথা থেকে :
২০১০ সাল পর্যন্ত এক পর্বে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন হলেও অতিরিক্ত লোক সমাগমের কারণে ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। দুই পর্বেই টঙ্গীর তুরাগ তীরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের তাবলীগ অনুসারীরা অংশগ্রহণ করতেন।
তবে বিশ্ব ইজতেমাসহ তাবলীগের বিভিন্ন মজলিসে দেওয়া মাওলানা সাদের কিছু বক্তব্যে আপত্তি রয়েছে বলে চিহ্নিত করে ভারতের অন্যতম ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া বিভাগ। আপত্তিকর বক্তব্যের সঙ্গে যুক্ত হয় মাওলানা সাদের একক আমীর দাবির বিষয়টি। সেই থেকে দুই ভাগ হয়ে যায় তাবলিগ জামাত। ফলে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ইজতেমা।
বিভক্তি দেখা দিলে বিষয়টি সমাধান করতে তাবলীগের শূরা কমিটি (পরিচালনা পর্ষদ) বেশ কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায়। এরমধ্যেই ২০১৮ সালে বাংলাদেশে তাবলীগের দুই পক্ষ বা দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এ সময় তাবলীগের শূরায়ে নিজাম (মাওলানা জুবায়েরপন্থি) বলে পরিচিত পক্ষটি মাওলানা সাদকে বাংলাদেশের বিশ্ব ইজতেমায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা ও তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানায়।
এরপর তাবলীগের দুইপক্ষ দুটি মেরুতে অবস্থান নেন। দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসার প্রাথমিক দিনগুলোতে দুই পক্ষ পরস্পর বিরোধি অবস্থানে থাকলেও বিষয়টি জটিলতায় রূপ নেয় ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর ইজতেমা মাঠে সংঘর্ষকে কেন্দ্র। সর্বশেষ গতকাল আবারো রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে তাবলীগের দুইপক্ষের দ্বন্দ্ব।
শান্ত থাকার আহবান জামায়াত আমীরের :
বিষয়টি নিয়ে বুধবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জামায়াত ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ভোর রাতে তুরাগ তীরে টঙ্গীর ইজতেমা মাঠে তাবলীগী জামায়াতের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ৪ জন মুসল্লির ইন্তিকালে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত। মহান আল্লাহর দ্বীনের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সকলকে সবর করার এবং শান্ত থাকার জন্য আন্তরিকভাবে আহ্বান জানাই। তিনি বলেন, বিষয়টি যৌক্তিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হোক। দেশ এবং উম্মাহর স্বার্থে সকলেই ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসুন।