নির্বাচন নিয়ে আশা-নিরাশা
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৮:২৯ অপরাহ্ন
নির্বাচন নিয়ে সরকারের বক্তব্য অস্পষ্ট, হতাশাজনক : বিএনপি | ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনী সংস্কার প্রস্তাবনা : কমিশন প্রধান
জালালাবাদ রিপোর্ট : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়টা যেন ঘোষণা হয়েও হলো না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছিলেন, ২০২৫ সালের শেষ দিক থেকে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। তবে রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বা রোডম্যাপ নেই। ফলে নির্বাচন কবে- এ নিয়ে এখনো আশা-নিরাশার দোলাচলে দলগুলো।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপি সংবাদ সম্মেলন করে তাদের হতাশার কথা জানিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা যে সময়ের কথা বলেছেন তা যৌক্তিক মনে হয়নি। আমরা আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা রোডম্যাপ দেবেন। কিন্তু তিনি তা দেননি। এটা আমাদের হতাশ করেছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠন হয়ে গেছে। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো প্রস্তুতি দেখছি না। নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণ ও তাঁর প্রেস সচিবের বক্তব্যকে সাংঘর্ষিক বলেও উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব। তিনি বলেন, তাঁদের দেওয়া বক্তব্য কোনটা সঠিক, আমরা বুঝতে পারছি না।
এই সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত লিখিতভাবেও জানানো হয়। তাতে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছেন, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে উপদেষ্টার ভাষণের যে ব্যাখ্যা দেন, তা নিয়েও সভায় আলোচনা হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটি মনে করে, ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ভাষণে নির্বাচন সংক্রান্ত বক্তব্য অস্পষ্ট। তাঁর বক্তব্যে নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের কথা বলা হলেও নির্বাচনের রোড ম্যাপ সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রাখা হয় নি।
স্থায়ী কমিটির সভা থেকে এ-ও বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনুস নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় সীমা ২০২৫ সালের শেষ অথবা ২০২৬ সালের প্রথম অংশে অনুষ্ঠানের কথা বলেন, যা একেবারেই অস্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট কোন সময় উল্লেখ নেই। অথচ তাঁর প্রেস সচিব বলেন যে, ২০২৬ সালের জুন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যা পরস্পর বিরোধী। এই ধরনের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য আরো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
একই ধরনের অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে জামায়াতেও। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ দুই দিন আগে একটি গণমাধ্যমে বলেন, সংস্কার ও নির্বাচনের সময় নিয়ে একটি রোডম্যাপ আশা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য তাঁরা পেলেন না। তিনি বলেন, ভোটের একটা সম্ভাব্য সময়ের ইঙ্গিত দেওয়া হলো, সেটাও বলা হলো ভোটার তালিকা তৈরির শর্তে।
বামপন্থী দলগুলোও নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। এই দলগুলো সংস্কার এবং নির্বাচনের দিনক্ষণ দিয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ চায়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় নিয়ে একটা ধারণা দিয়েছেন, সেটা একটা সুখবর বটে। তিনি মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি রোডম্যাপ তৈরি করা সম্ভব।
রোডম্যাপ প্রশ্নে দলগুলো এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে সংলাপ আশা করছে। তারা বলছে, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। এরপর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে রোডম্যাপ তৈরি করা হলে সব সন্দেহ-সংশয় দূর হবে।
অবশ্য সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান গত সেপ্টেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে নির্বাচনের জন্য ১৮ মাসের একটি সময়ের উল্লেখ করেছিলেন, যা রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
যদিও সরকার শুরুতে সংস্কার কর্মসূচির দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছিলো। তবে সরকারের দু-একজন উপদেষ্টা নির্বাচনের সময় নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় এলেও পরে তারা বলেছেন, এটি প্রধান উপদেষ্টার এখতিয়ার এবং তিনিই সেটি ঘোষণা করবেন। শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্তি দূর করতে প্রধান উপদেষ্টাই নির্বাচনের একটি সময়ের ইংগিত দিয়েছেন। যদিও বিএনপি গতকাল বলেছে, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর বিভ্রান্তি আরো বেড়েছে।
এদিকে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, সেই সুপারিশ করবেন বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রংপুরে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, নির্বাচনে অযোগ্য না হলে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ থাকা উচিত। আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে সংস্কার কমিশন থেকে কোনো রকম বাধা দেওয়া হচ্ছে না, সেটা নির্বাচন কমিশনের ব্যাপার।
তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার প্রস্তাবনার কাজ প্রায় শেষ দিকে। হাজারও প্রস্তাবনা এসেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত প্রস্তাবনা ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সরকারের কাছে তুলে দেওয়া হবে। এরপর সেই প্রস্তাবনা নিয়ে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনা করে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করবে। এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটবে।
তবে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গতকালই মুখপাত্র উমাম ফাতেমার পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে একাধিক গণহত্যার জন্য দায়ী গোষ্ঠী। আওয়ামী লীগ বিগত তিনটি নির্বাচনকে অবৈধ উপায়ে নিজেদের কুক্ষিগত করেছে। যে দলটি বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে, তাদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান জনআকাঙ্খার বিরুদ্ধাচারণ।
এদিকে, নির্বাচনের প্রস্তুতি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য অনির্ধারিত গতকাল বৃহস্পতিবার বৈঠকে বসেছিল নতুন নির্বাচন কমিশন। বিকেল ৩টায় নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাছির উদ্দিনের সভাপতিত্বে এই বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে দেশের ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।