পাঠ্যবইয়ের মহাসংকট!
প্রকাশিত হয়েছে : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:২০:৪৯ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : আগামী নতুন বছরের পাঠ্যবই নিয়ে মহাসংকটে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এখনো ২৫ কোটি বই ছাপার কাজ শুরুই হয়নি। ফলে আগামী মার্চের আগে সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অনেকেই। এতে শিক্ষার্থীদের বড় ধরনের শিখন ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে।
স্কুল-কলেজে এক শিক্ষাবর্ষে সাধারণত ৭৬ দিনের ছুটি থাকে। এর সঙ্গে দুই দিন করে সাপ্তাহিক ছুটি যোগ করলে আরো ১০৪ দিন বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই হিসাবে এক বছরে ক্লাস-পরীক্ষা চলে ১৮৫ দিন। আর এই অনুসারেই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, আগামী মার্চের প্রায় শুরু থেকেই রোজা ও ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার কথা। এখন বই হাতে পাওয়ার পর যদি ছুটি শুরু হয়ে যায়, তাহলে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ ছাড়া পুরোপুরিভাবে ক্লাস শুরু করা সম্ভব নয়। এতে এক বছরের সিলেবাস ৮ মাসে শেষ করতে হবে। শিক্ষকরা এই সময়ে জোর করে পড়া চাপিয়ে দিলেও শিক্ষার্থীরা তা ঠিকমতো আয়ত্তে নিতে পারবে না। এতে আগামী বছর বড় ধরনের শিখন ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
শিক্ষকরা বলছেন, গত দুই বছর নতুন শিক্ষাক্রমে পড়ালেখা করেছে শিক্ষার্থীরা। সেখানে ভিন্নধর্মী পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো চাপ নিতে হয়নি। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যেতে হয়েছে। এতে এমনিতেই বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে শিক্ষার্থীরা।
অনেক শিক্ষার্থীই তাল মেলাতে পারছে না। তারা এ বছরের বার্ষিক পরীক্ষায় খুব খারাপ করেছে। এখন যদি আবার বই পেতে পেতে তিন মাস সময় চলে যায়, তাহলে বড় ধরনের দুর্ভোগে পড়বে শিক্ষার্থীরা।এনসিটিবি সূত্র জানায়, আগামী শিক্ষাবর্ষের জন্য ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২টি পাঠ্যবই ছাপার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিকের বই ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি। বাকি প্রায় ৩০ কোটির বেশি বই মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কারিগরি স্কুলের।
সূত্র জানায়, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ বেশ আগেই শুরু হয়েছে, যা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই বইয়ের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। এরপর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির কার্যাদেশ ও চুক্তিপত্র শেষে এই সপ্তাহেই তা ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। এই বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি।
তবে ১০ ও ১১ ডিসেম্বর চতুর্থ, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির কার্যাদেশ দেওয়া হলেও প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে প্রেস মালিকদের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। ফলে এই তিন শ্রেণির বইয়ের কাজ শুরু হয়নি। আর নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন শেষে এখনো কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি।
দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, এ বছর চুক্তির পর বই ছাপার কাজ শেষ করতে সময় দেওয়া হয়েছে মাত্র ৪০ দিন। কিন্তু আগের বছরগুলোতে এই সময় ৭০ দিন দিয়েও যথাসময়ে বই পাওয়া সম্ভব হয়নি। অথচ এ বছর সব কাজ একসঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। ফলে কোনোভাবেই ৪০ দিনে বই দেওয়া সম্ভব নয় বলে প্রেস মালিকরা জানিয়েছেন। কিন্তু সব কিছু জেনে-বুঝেও তাঁদের অবাস্তব চাপ দিচ্ছে এনসিটিবি।
এই পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার প্রেস মালিক ও এনসিটিবির কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সেখানে আগামী জানুয়ারির ১৫ দিনের মধ্যে অন্তত তিনটি করে বই (বাংলা, ইংরেজি ও গণিত) দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। কিন্তু প্রেস মালিকরা সেখানে পুরোপুরি কথা দিয়ে আসেননি।
প্রেস মালিকরা বলেছেন, ‘একসঙ্গে সব বইয়ের কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। যদি কিছুদিন সময় দিয়ে কার্যাদেশ দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো আমরা তিনটি করে বই দিতে পারতাম। এ ছাড়া আমরা প্রচ- রকমের কাগজের সংকটে ভুগছি। বেশি দাম দিয়েও এত কাগজ কিনতে পারছি না। ফলে ছাপার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।’পরে শিক্ষা উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, ‘যথাসময়ে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, বিতরণ ও সরবরাহ করে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম অগ্রাধিকারমূলক কাজ। এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি।’
উপদেষ্টা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বই ছাপানোর কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে এবং যথাসময়ে ছাত্রছাত্রীদের কাছে পৌঁছানো যাবে। তবে মাধ্যমিক শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর কাজ একটু ধীরগতির হওয়ায় এই কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রক ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমরা আগে থেকেই বলে আসছিলাম, বছরের শুরুতে যাতে শিক্ষার্থীদের হাতে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি বই তুলে দিতে সেভাবে পরিকল্পনা করতে হবে। কিন্তু তাঁরা আমাদের কথা শোনেননি। অথচ এখন বাকি আছে ১১ দিন।
সব শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশও দেওয়া হয়নি। অথচ আমাদের কাছে তিনটি করে বই চাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এত অল্প দিনে তা সম্ভব নয়। এ ছাড়া বাজারে কাগজেরও সংকট রয়েছে। তবে আমরা এটুকু বলতে পারি, আমরা আমাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর সাধারণত জুলাই-আগস্ট থেকে পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হয়। এরপরও ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু এ বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এনসিটিবিতে অনেক পরিবর্তন আসে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, সদস্য ও অন্য কর্মকর্তারা পরিবর্তন হন।এরপর আবার আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া হয়। পাঠ্যক্রমেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। কিন্তু এনসিটিবির নতুন কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাবে এই পাঠ্যবইয়ের কাজ অনেক পিছিয়ে গেছে। নয়তো আরো অন্তত ১৫ থেকে ৩০ দিন আগে বেশির ভাগ বই ছাপার কাজ শুরু করা সম্ভব হতো।
২০২৫ শিক্ষাবর্ষের খসড়া শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী, আগামী বছর ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে ২৪ জুন, চলবে ১০ জুলাই পর্যন্ত। একই সময়ে দশম শ্রেণিতে প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষা নেওয়া হবে। ২৭ জুলাইয়ের মধ্যে অর্ধবার্ষিক ও প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে হবে। দশম শ্রেণিতে নির্বাচনী পরীক্ষা শুরু হবে ১৬ অক্টোবর। এই পরীক্ষা চলবে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। একই সঙ্গে শিক্ষাপঞ্জিতে নির্বাচনী পরীক্ষার ফলাফল ১০ নভেম্বরের মধ্যে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে আগামী শিক্ষাবর্ষে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হবে ২০ নভেম্বর, যা চলবে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
শিক্ষকরা বলছেন, বছরের শুরুতে যদি নতুন বই শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া না যায়, তাহলে আগামী বছরের এই খসড়া শিক্ষাপঞ্জি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় সব বই ডিসেম্বরের মধ্যে ছাপা হয়ে যাবে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বইও ছাপা শুরু হয়েছে। আর নবম-দশম শ্রেণির বই ছাপার বিষয়ে ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আজকালের মধ্যে ছাপার কার্যাদেশ দেওয়া হতে পারে। মাধ্যমিকের বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই আগে ছাপানোর চেষ্টা করছি। সেটা সম্ভব হলে প্রাথমিকের ১০ কোটি ও মাধ্যমিকের ১০ কোটি বই ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের দেওয়া যাবে। বাকি বইগুলো পরে দেওয়া হবে।