সালতামামি ২০২৪: নিষিদ্ধ থেকে রাজনীতির সম্মুখভাগে জামায়াত
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৫০:০৬ অপরাহ্ন
জালালাবাদ ডেস্ক: আওয়ামী লীগ টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধও করে ফ্যাসিস্ট তকমা পাওয়া শেখ হাসিনার সরকার। তবে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর সুদিন ফিরে আসে। প্রায় দেড় যুগ পর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরে দলটি।
আওয়ামী লীগের পতনের পর ঢাকাসহ সারাদেশে দলীয় কার্যালয়গুলো চালু করেছে জামায়াত। রাজনীতিতে বেশ সরব হয়ে উঠেছে দলটি। সারাদেশ চষে বেড়াচ্ছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। জেলায় জেলায় পালিত হচ্ছে নানা কর্মসূচি। মাত্র কয়েক মাস আগে নিষিদ্ধ ঘোষিত দলটি এখন রাজনীতির সম্মুখভাগে চলে এসেছে। নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন ইতোমধ্যে বাতিল হয়েছে। নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়াও চলমান। প্রায় এক যুগ ধরে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় রাজনৈতিক যে স্থবিরতা এসেছিল তা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে চায় জামায়াত। এজন্য দলটি নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়োর পক্ষে নয়।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা লাপাত্তা। অপরদিকে নানা অপকর্মে জড়িয়ে অনেকটা বিতর্কের মুখে পড়েছে বিএনপি। এই সুযোগে নিজেদের কর্মকা-ে জনসমর্থন বাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে জামায়াত। দলটি মনে করছে, জনসাধারণের কাছে নিজেদের ইতিবাচকভাবে উপস্থাপনের এখনই সময়। এজন্য ইতোমধ্যে কিছু ইতিবাচক কর্মকা-ের মাধ্যমে বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছে জামায়াত। দেশের সংখ্যালঘুরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখছে দলটি। হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘর পাহারা দেওয়া থেকে শুরু করে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে জামায়াত। হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলটির নেতারা। তাদের আশ্বস্ত করেছেন, জামায়াত ক্ষমতায় এলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো সমস্যা হবে না।
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন: ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার মাত্র চার দিন আগে গত ১ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে সে সময় এই ইস্যুতে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি জামায়াত। দলটি তখন নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পুরো মনোযোগ ব্যয় করে ছাত্র আন্দোলনে। ফলে জামায়াত নিষিদ্ধের মাত্র চার দিন পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পটপরিবর্তনের পর গত ২৮ আগস্ট জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয় অন্তর্র্বতী সরকার। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির বা এর কোনো অঙ্গ সংগঠনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও সহিংসতায় সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানায় সরকার। এখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় আছে দলটি।
১৪ বছর পর আজান দিয়ে কার্যালয় চালু: শেখ হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৪ বছর পর দলের কেন্দ্রীয় ও মহানগরীর কার্যালয়ে কার্যক্রম শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার দিন ৫ আগস্ট রাতে দলটির নেতাকর্মীরা মগবাজারে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান। এসময় নেতারা দীর্ঘদিন পর কার্যালয়ে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং বিশেষ মোনাজাত করেন। এরপর তারা পুরানা পল্টনে মহানগর কার্যালয়েও যান। এখন সারাদেশের দলীয় কার্যালয়গুলো বেশ সক্রিয় হয়ে ওঠেছে।
সেনাপ্রধানের বৈঠকে জামায়াতের আমীর: শেখ হাসিনার পালানোর পর দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সংকট নিরসনে ৫ আগস্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেই বৈঠকে ডাক পান জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। বৈঠক শেষে সেনাপ্রধান সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকলেও তখন জামায়াত আমিরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করেন সেনাপ্রধান।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে জামায়াত: স্বৈরশাসক হাসিনার পতনের পর দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৫ আগস্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সমাজের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে বঙ্গভবনে বৈঠক করেন রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন। সেই বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান আমন্ত্রণ পান।
এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর বেশ কয়েক বার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছেন। প্রতিবারই বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে ডাক পেয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
১৯ বছর পর প্রকাশ্যে রুকন সম্মেলন: জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে অনুকূল পরিবেশ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ১৯ বছর পর প্রকাশ্যে বড় পরিসরে রুকন সম্মেলন করে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর উত্তর শাখা। গত ১৩ অক্টোবর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। একই স্থানে গত ১৮ অক্টোবর ঢাকা দক্ষিণ জামায়াতের রুকন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক: বাংলাদেশ সফররত জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে জামায়াতে ইসলামী। গত ১২ ডিসেম্বর দুপুরে রাজধানীর গুলশানে জাতিসংঘের আবাসিক কার্যালয়ে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের নেতৃত্বে দলটির চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল এই বৈঠকে অংশ নেয়।
আন্দোলনে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে যেসব ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছে তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। প্রতিটি পরিবারের মধ্যে নগদ এক লাখ টাকা অর্থ সহায়তা দিয়েছে দলটি। এছাড়া আহত অবস্থায় যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে দলটি। হাসপাতালে গিয়ে তাদের সার্বিক খোঁজখবর নেওয়াসহ আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
৯ বছর পর সোনারগাঁও হোটেলে জামায়াতের ইফতার: প্রায় নয় বছর পর রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনদের নিয়ে রাজধানীতে বড় পরিসরে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে জামায়াতে ইসলামী। গত ৩০ মার্চ রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে এই ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ২৫ জুন হোটেল সোনারগাঁওয়ে রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বিশিষ্টজনদের নিয়ে ইফতার করেছিল জামায়াতে ইসলামী।
প্রথম বার চীন সফরে জামায়াতের প্রতিনিধি দল: চীন সরকারের আমন্ত্রণে দেশটিতে আট দিন সফর করেছে জামায়াতে ইসলামীর একটি প্রতিনিধি দল। দলটিতে অন্যান্য ইসলামি দলের নেতারা থাকলেও নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াত নেতারা। গত ২৭ নভেম্বর রাত সোয়া ১১টায় চায়না সাউদার্ন এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন তারা। ফিরেন ৫ ডিসেম্বর। জামায়াতসহ কোনো ইসলামি দলের নেতাদের চীনের ক্ষমতাসীন দলের আমন্ত্রণে সে দেশে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। এর আগে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধি দল দেশটি সফর করেছে।
বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে বৈঠক: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়তে তৎপরতা শুরু করেছেন বিদেশি কূটনীতিকরা। বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা নতুন করে সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিগত শেখ হাসিনা আমলে সরকারের আমলে অনেক বিদেশি কূটনীতিক বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করতে স্বস্তি পেতেন না। অনেক দেশের কূটনীতিক সে সময় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে এড়িয়েও চলেছেন। তবে পরিস্থিতি এখন বদলেছে। তাই কূটনীতিকরাও এখন আর বসে নেই।
ইসলামপন্থীদের নিয়ে নির্বাচনি ঐক্য গড়ার চেষ্টা: ইসলামপন্থী কয়েকটি দলের সঙ্গে ‘নির্বাচনি ঐক্য’ গড়ে সংসদ নির্বাচনে লড়ার চিন্তা করছে জামায়াতে ইসলামী। এ লক্ষ্যে দলটি ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি ইসলামি দল এবং আলেমদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে। জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা জানান, বিভিন্ন কারণে বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপির সঙ্গে তাদের বনিবনা হওয়ার সম্ভাবনা কম। আগামী সংসদ নির্বাচনে ভালো রেজাল্টের জন্য ইসলামপন্থীদের সঙ্গে একটি নির্বাচনি ঐক্য গড়তে চাইছেন। যদিও তা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো রূপ নেয়নি। নির্বাচনের আগে আদৌ রূপ নেবে কি না তা এখনই বলা যাচ্ছে না।