বিদায় ২০২৪ : স্বাগত ২০২৫
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০১:৩২ অপরাহ্ন
নিজাম উদ্দীন সালেহ
বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যরে একটি কবিতার কয়েকটি বিখ্যাত পংক্তি হচ্ছে : আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ/স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি/আঠারো বয়সেই অহরহ/বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
গত ২০২৪ সালে সুকান্তের এই আঠারো তথা তারুণ্যের জয়জয়কার ও বিজয়ের বছর। কারণ এ বছরের জুলাই-আগস্টে রীতিমতো ভূমিকম্প ঘটে গেছে বাংলাদেশে। ২০২৪ মানেই বিপ্লব, বিপ্লবের বছর। বছরটি ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে। গতকালের শেষ সূর্যের রঙিন আভা ছড়িয়ে বিজয়ীর বেশে বীরদর্পে বিদায় নিয়েছে ঐতিহাসিক ‘চব্বিশ’। ইতিহাসের বুকে সোনালী হরফে অংকন করে গেছে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়, বিজয়ের উপাখ্যান, এক নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনা।
বলা বাহুল্য, শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ^ কাঁপানো গণঅভ্যুত্থান তথা বিপ্লবের বছর ছিলো ২০২৪ সাল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭১ সালের পর ২০২৪ সালের মতো কোন বছর আসেনি, যা এতো প্রচন্ডভাবে নাড়া দিয়েছে গোটা দেশ ও জাতিকে। ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে এই সংগ্রামী বছর ২০২৪, কিন্তু এর জেরও রেশ আজো কাটেনি, ফুরিয়ে যায়নি তার আবেদন ও প্রতিশ্রুতি। ছাত্র-জনতার অব্যাহত আন্দোলন বিক্ষোভ ও জাগরণের মধ্যে দিয়ে লক্ষণীয় তার অনুরণন।
নতুন আশা প্রত্যাশা ও স্বপ্ন নিয়ে আজ শুরু হচ্ছে নতুন বছর ২০২৫। বিগত বছরের দিকে তাকালে বাংলাদেশসহ বিশ^জুড়ে এক মিশ্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও চালচিত্র লক্ষ্য করা যায়। একদিকে প্রচন্ড অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা, অপরদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠার অদম্য প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। গোটা ২০২৪ সাল জুড়ে বিশে^র বেশ কিছু অঞ্চলে বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের ইউক্রেইযনে যুদ্ধ-সংঘাতের ব্যাপকতা ছিলো দৃশ্যমান। এ সকল অঞ্চল এখনো যুদ্ধ বিক্ষুব্ধ ও সংঘাতপূর্ণ রয়ে গেছে। যুদ্ধের তীব্রতা আংশিক হ্রাস পেলেও স্থায়ী সমাধান বা যুদ্ধবিরতির কোন আলামত এখনো দৃশ্যমান নয়।
গত বছর বিশে^র রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বড়ো ঘটনা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়। শুধু যুক্তরাষ্ট্র, আমেরিকা বা ইউরোপ নয়, গোটা বিশ^কে আলোড়িত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের এই নির্বাচন। কিছুটা উগ্র ও মারমুখী রাজনীতিবিদ ট্রাম্পের বিজয় অনেক দেশকেই সতর্ক ও সচকিত করেছে। তার সময়ে বিশে^র একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের বৈশি^ক নীতিমালা কী হয়, এ নিয়ে তুমুল আলোচনার সূত্রপাত হয় ট্রাম্পের বিজয়ে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিদায়ী বছর ২০২৪ সালে ছিলো ভালো মনের মিশ্রণ। পণ্য বিশেষভাবে খাদ্যপণ্যের দাম কখনো বেড়েছে, আবার কখনো কমেছে। তবে জ¦ালানী তেলের দামে তেমন কোন অঘটন লক্ষ্য করা যায়নি বিগত বছরে। মোটামুটি স্থিতিশীল ছিলো এটি। চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনার আবহ ছিলো আগের মতোই, তবে কোন সংঘাত হয়নি সীমান্তে। পাকিস্তানের সাথে ভারতেরও তেমন কোন উত্তেজনা ছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ছিলো আগের মতোই রক্তাক্ত। দুর্বৃত্ত ভারতের ততোধিক দুর্বৃত্ত ও নিষ্ঠুর এবং বার বার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী চাণক্যপন্থী মোনাফেক বিএসএফ ও ভারতীয় লোকজন বহু নিরস্ত্র বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে গত বছর। প্রতিপক্ষ নিরস্ত্র ও আক্রমনাত্মক না হওয়া সত্বেও এসব বাংলাদেশীকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ঝর্ণা নামক জনৈক কিশোরীসহ আরো বহু কিশোর তরুণ ও রেহাই পায়নি তাদের নৃশংসতা থেকে। বাংলাদেশের বিপ্লব বা অভ্যুত্থানকে প্রতিবেশী ভারত আজো ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। তারা বাংলাদেশ থেকে পলাতক স্বৈরশাসক হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে আবারো রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করছে, যা বাংলাদেশের আগামী দিনগুলোর জন্য অশনি সংকেত স্বরূপ। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোসহ বিশে^ সব কটি দেশই বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়েছে।
ইতোমধ্যে ‘দ্যা ইকোনমিস্ট’ বাংলাদেশের আগস্ট-জুলাই বিপ্লবকে এতোটা গুরুত্ব দিয়েছে যে, বাংলাদেশকে ‘কান্ট্রি অব দ্য ইয়ার-২০২৪’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। শুধুমাত্র ভারতীয় মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানকে একটি অসামান্য ‘ওয়ার্ল্ড ইভেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের মিডিয়াগুলোর মিথ্যাচার বিশ^ব্যাপী নিন্দিত হচ্ছে। ভারতের মুসলিম ও বাংলাদেশ বিদ্বেষী বিজেপি সরকারের সমর্থনপুষ্ট ও আজ্ঞাবহ বাংলা, হিন্দি ও ইংলিশ ভাষার মিডিয়াগুলো বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণায় তুঙ্গে ছিলো গোটা ২০২৪ সাল। বাংলাদেশে কল্পিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির জঘন্য অপতৎপরতা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
ভারত সরকার অনেকটা গৃহবন্দী অবস্থায় থাকা হাসিনার বেশ কিছু ভিডিও বার্তা প্রচারে সহায়তা করেছে গত বছর। এখন এটা কমেছে বা বন্ধ রয়েছে। বিগত বছর আনসার বিদ্রোহ এবং অতিসম্প্রতি সচিবালয়ে অগ্নিকান্ডের ঘটনা বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় জনগণকে বিক্ষুব্ধ ও হতাশা করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চেষ্টা করছে সব ধরনের বিশৃংখলা মোকাবেলায়। ইতোমধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়নে বিশেষভাবে ব্যাংক খাতের উন্নয়ন ও সংস্কারে তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। দ্রব্যমূল্য তথা মূল্যস্ফীতিও ক্রমশঃ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসছে। সিন্ডিকেট ভাঙ্গার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ভারতের একচেটিয়া ব্যবসার চক্রজাল ভেদ করে পাকিস্তানসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। ফলে অনেক পণ্যের দাম বিশেষভাবে নিত্যপণ্য পেঁয়াজের দাম কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থায় চলে এসেছে। বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানের পণ্যবাহী জাহাজের আগমনে দুর্বৃত্ত দেশ ভারতের হৈ চৈ ছিলো বিগত বছরের একটি লক্ষণীয় ঘটনা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন দেখছে এক নতুন সমৃদ্ধ ও উন্নত ভবিষ্যতের। স্বপ্ন দেখছে স্থায়ী সুখ ও শান্তির। এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। প্রয়োজন সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচনের। দেশবাসী সেই লক্ষ্যে তাকিয়ে আছে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রক ও নীতি নির্ধারক সকল মহলের দিকে। শুভ হোক ইংরেজী নববর্ষ ২০২৫। সবশেষে অফুরান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বিপ্লবে প্রাণ উৎসর্গকারী শহীদদের, শুভেচ্ছা, অভিনন্দন ও সমবেদনা আহত, পঙ্গু ও চক্ষুহারা বীর ছাত্র-জনতাকে। আমরা গোটা জাতির পক্ষ থেকে সকল রুহের মাগফেরাত ও আহতদের আশু সুস্থতা কামনা করছি।