২০ শতাংশ বইয়ে শিক্ষাবর্ষ শুরু
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ৯:২৬:১৪ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : নতুন বছরের প্রথম দিন মানেই শিক্ষার্থীদের নতুন বইয়ের ঘ্রাণ। ১ জানুয়ারি দেশের প্রতিটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের কাছে বিনামূল্যের বই পৌঁছে দেয়ার কথা থাকলেও এ বছর তা সম্ভব হয়নি। সিলেট বিভাগে ১ম, ২য় ও ৩য় শ্রেণীর ৮০-৯০ শতাংশ বই পৌছানো গেলেও প্রাক প্রাথমিক, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণীর কোন বই পৌছেনি।
শুধু সিলেট নয়, এই চিত্র সারাদেশের। নতুন বছরের প্রথম দিন বুধবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের জন্য ২০ শতাংশেরও বই প্রস্তুত প্রেরণ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এর ফলে বছরের প্রথম দিন সব শ্রেণির শিক্ষার্থী সববই ছাড়াই ২০২৫ শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়েছে। এদিকে বরাবরের মতো উৎসব না হলেও বুধবার সকাল ১০টায় রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে (আমাই) নতুন বছরের বইয়ের পিডিএফ ভার্সন অনলাইনে উদ্বোধন করেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
সাবেক আওয়ামী সরকারের নতুন কারিকুলাম বাতিল করে পরিমার্জনসহ বই তৈরি, আগের দরপত্র বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বান, বইয়ের উৎপাদনকাজ তদারকির জন্য এনসিটিবির নিয়োগকৃত ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগে দেরি, বই ছাপার শর্ত অনুযায়ী কাগজের অভাব ও কাগজের ‘বাস্টিং’ না মেলা ইত্যাদি নানা কারণে এবারের বই সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার কারণ বলে এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে। তবে এ নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে এনসিটিবির মধ্যেই। সূত্রের দাবি, দরপত্র বাতিল করলে বই ছাপানোর প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হবে বলে পর্যালোচনা থাকলেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা বা বিকল্প চিন্তা ছিল না নীতিনির্ধারণী মহলে। পাশাপাশি মাধ্যমিক স্তরে ইন্সপেকশন এজেন্ট নিয়োগ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কারণেও বই ছাপার কাজ পিছিয়ে গেছে অনেক সময়।
এ বিষয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, প্রেসগুলোর অপকৌশলের কাছে নতিস্বীকার না করার কারণে বইয়ের সংখ্যা কম। আমরা বইয়ের গুণগত মানের দিকে নজর দিয়েছি। মানে আপোষ করলে ডিসেম্বরের মধ্যেই বই পাওয়া যেত।
জানা গেছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ৪ কোটি ৩৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৩ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপা হওয়ার কথা ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। এ ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে ৮ হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য ছাপা হচ্ছে প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা বই।
মোট বইয়ের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিকের ২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই। গত সোমবার পাওয়া হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, এই স্তরে মোট ছাপানো হয়েছে ৪ কোটি ৫১ লাখ ৮৮ হাজার ৫০০ কপি। অর্থাৎ মোট বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ বই।
অন্যদিকে মাধ্যমিকের ৬ষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ২ কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানোর কথা ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। সেখানে গতকাল পর্যন্ত ছাপানো হয়েছে মাত্র ২ কোটি ৮২ লাখ ৪ হাজার ৭৩৬ কপি বই। অর্থাৎ মোট বইয়ের মধ্যে ছাপা হয়েছে ১০ শতাংশেরও কম বই। এই বইগুলোর মধ্যে প্রধান তিনটি বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বই রয়েছে।
এনসিটিবির হিসাব অনুযায়ী বাংলা, ইংরেজি ও গণিত তিনটি বই- ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির প্রায় সোয়া দুই কোটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৭ কোটি বই। সেখানে ছাপা হয়েছে প্রায় ৩ কোটি বই। অর্থাৎ এই স্তরের সব শিক্ষার্থীও তিনটি বই পাচ্ছে না।
তবে এ সংখ্যা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পিডিআইয়ের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে প্রায় ৫ কোটি বই উপজেলা পর্যায়ে বুধবার পৌঁছে গেছে। প্রত্যেক শিক্ষার্থী যাতে তিনটি করে বই পায় সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রেরণ করা হয়েছে।
এর আগে প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) সম্পন্ন করে ছাড়পত্র পাওয়া বইও উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানো বইয়ের সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত করে প্রচার করা এনসিটিবিতে প্রচলিত ছিল। সাধারণত বছরের প্রথম দিন বই দেওয়ার প্রচ- চাপের কারণে প্রেসগুলো পিডিআই ছাড়পত্র নিয়ে সংখ্যা বাড়িয়ে দেখাত। পরে নিজেদের মতো করে বই সরবরাহ করত। চলতি বছর এমনটা হচ্ছে না বলেই মত ব্যক্ত করেছেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান।
এদিকে গত সোমবার এনসিটিবির একটি মনিটরিং কমিটির ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক স্তরের বইয়ের মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকে দেখা গেছে, এই কমিটির দায়িত্বে ছিল ৮টি প্রেস। এই ৮টি প্রেস তাদের কাজের বিপরীতে সরবরাহ করেছে ৪৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ বই। একটি বইও সরবরাহ করেনি এমন রয়েছে দুটি প্রেস। তবে অগ্রগতি প্রতিবেদনে যেসব স্থানে বই পৌঁছানো হয়েছে তার নাম উল্লেখের ঘরে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বই উৎপাদন ও উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বরাবরই ভিন্নতা দেখা যায়। উল্লিখিত মনিটরিং কমিটির অগ্রগতি প্রতিবেদন থেকেও উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহের সঠিক সংখ্যা পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, প্রেসগুলো উপজেলা পর্যায়ে বই সরবরাহ করে চালান জমা দেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে। ফলে এনসিটিবির পক্ষে উপজেলা পর্যায়ে কত বই পৌঁছেছে, তার হিসাব রাখা সম্ভব হয় না। পরবর্তী সময়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সংখ্যাটা অবহিত করলে এনসিটিবি তা জানতে পারে।
প্রাথমিক স্তরের বই উৎপাদন ও বিতরণের হিসাব থেকে দেখা গেছে, প্রাক-প্রাথমিকের ৬২ লাখ ১৮ হাজার ৩৩৪ কপি বইয়ের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে ৩০ লাখ ৯৩ হাজার ৩২৯ কপি। অর্থাৎ মোট বইয়ের মধ্যে পৌঁছেছে ৫০ শতাংশ। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ৭০টি লটের মোট ৩ কোটি ৯ লাখ ৭৪ হাজার কপি বইয়ের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে ৩ কোটি বই। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির ২৮টি লটের ১ কোটি ২৮ লাখ ৯৩ হাজার ৪৬০ কপি বইয়ের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে ৪৮ লাখ ২ হাজার ৭৬৮ কপি। যা মোট বইয়ের মধ্যে ৪০ শতাংশ।
অন্যদিকে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ৪ কোটি ৩ লাখ ৬১ হাজার ৪০০ কপি বইয়ের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে প্রায় ৭১ লাখ। অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি বই ছাপা বাকি। তবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রায় দুই লাখ বইয়ের শতভাগ উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এদিকে গত সোমবার দুপুর পর্যন্ত অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির ৪৫৫টি লটের মধ্যে অর্ধেকের মতো লটের বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবির সঙ্গে চুক্তিই করেনি কাজ পাওয়া প্রায় অর্ধশত প্রেস। এসব লটে বইয়ের পরিমাণ প্রায় ৭ কোটি। তবে এদিন সন্ধ্যার পর অনেক প্রেস চুক্তি করেছে বলে জানা গেছে। তবে এর সংখ্যাটা পাওয়া যায়নি। তারপরও চুক্তি না হওয়া লটগুলোর বই কবে ছাপা হয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছবে সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েই যাচ্ছে।