থামছেনা সড়কে মৃত্যু
প্রকাশিত হয়েছে : ০৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২০:২৭ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : কমানো যাচ্ছে না সড়কে মৃত্যু। দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গত বছর ৬ হাজার ৩৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৫৪৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১২ হাজার ৬০৮ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
শনিবার সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠনটি এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এসময় প্রতিবেদনের উপর কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। তাঁর মতে, সড়ক দুর্ঘটনার মাধ্যমে ‘কাঠামোগত হত্যাকান্ড’ হচ্ছে। গণ-অভ্যুত্থানের সুফল পরিবহন খাতে পড়েনি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশ, মৃত্যু বেড়েছে ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, আর আহতের সংখ্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত বছর রেলপথেও ৪৯৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫১২ জন নিহত এবং ৩১৫ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে ১১৮টি দুর্ঘটনায় ১৮২ জন নিহত, ২৬৭ জন আহত এবং ১৫৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌপথে মোট ৬ হাজার ৯৭৪টি দুর্ঘটনায় ৯ হাজার ২৩৭ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ১৯০ জন আহত হয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সিঙ্গাপুর বছরে সড়ক দুর্ঘটনার হার এক শতাংশে নামিয়ে এনেছে উল্লেখ করে রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, রাস্তা ঠিক থাকলে, চালকের লাইসেন্স থাকলে, সিগন্যাল ঠিক থাকলে এবং সবাই নির্দেশনা মেনে চললে তারা দুর্ঘটনা শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলছে। তার অর্থ, মানুষ চাইলেই এগুলো দূর করতে পারে। সরকার তা চাইছে না, বাসমালিকেরা তা চাইছেন না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন বলছে, গত বছর ২ হাজার ৩২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৬ দশমিক ৬২ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৫৭০ জন নিহত এবং ৩ হাজার ১৫১ জন আহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ৩০ দশমিক ০৮ শতাংশ এবং মোট আহতের ২৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
গত ১০ বছরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ১৫ লাখ থেকে বেড়ে ৬০ লাখ হয়েছে। নতুন করে ৬০ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রাস্তায় নামার পাশাপাশি ছোট যানবাহন অবাধে বেড়েছে। এসব যানবাহনের কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ভয়াবহভাবে বাড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৩৫ দশমিক ৮১ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪ দশমিক ৯৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরে, ১ দশমিক ২০ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরে এবং ০ দশমিক ৭৩ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংঘটিত হয়েছে।
প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, সরকার বদল হলেও পরিবহনের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন আসেনি। চাঁদাবাজির হাতবদল হয়েছে কেবল, ফিটনেসহীন যানবাহন সড়কে চলছে, আইনের অপপ্রয়োগ চলছে। বিআরটিএ রাজস্ব আদায়ে ব্যস্ত, ট্রাফিক বিভাগ জরিমানা আদায়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার যাবতীয় উপাদান সড়কে বিছিয়ে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কেবল সভা-সমাবেশে, বক্তৃতা-বিবৃতি আর পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মোজাম্মেল হকের মতে, সড়ক দুর্ঘটনা প্রকৌশলগত ত্রুটির কারণে ঘটে থাকে। সমাধানও প্রকৌশলগত হওয়া জরুরি।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১৩টি সুপারিশ তুলে ধরা হয় সংগঠনটির পক্ষ থেকে। এগুলো হলো-
মানুষের জীবন রক্ষায় সরকারের প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি অর্ন্তভুক্ত করা। দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করা। সড়ক নিরাপত্তায় বাজেট বরাদ্ধ বাড়ানো, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে সড়ক নিরাপত্তা উইং চালু করা। সড়ক নিরাপত্তায় ইতিমধ্যে প্রণীত যাবতীয় সুপারিশমালা বাস্তবায়নে নানা কার্যক্রম শুরু করা। দেশের সড়ক-মহাসড়কে রোড সাইন, রোড মার্কিং (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা। জেব্রা ক্রসিং অংকন ও আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা। গণপরিবহন চালকদের অত্যাধুনিক প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
সড়ক পরিবহন সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। অনিয়ম-দুর্নীতি ও সড়কে চাদাঁবাজি বন্ধ করা। গাড়ির নিবন্ধন, ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের পদ্ধতি উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করা।সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক সহায়তা তহবিলে আবেদনের সময়সীমা ৬ মাস বৃদ্ধি করা। স্মার্ট গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে দেশব্যাপী পর্যাপ্ত মানসম্মত নতুন বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয়া। ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের প্রশিক্ষণের জন্য ট্রাফিক ট্রেনিং একাডেমী গড়ে তোলা। সড়কের মিডিয়ানে উল্টো পথের আলো এবং পথচারীর পারাপার রোধে মহাসড়কের রোড ডিভাইডার পর্যাপ্ত উচু করা।
গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণ, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণসহ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিকদের সাথে ভুক্তভোগীদের পক্ষে যাত্রী সাধারনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।