তিব্বতে শক্তিশালী ভূমিকম্পে শতাধিক প্রাণহানী
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ৯:৪৫:২৫ অপরাহ্ন
সাতসকালে কাঁপলো বাংলাদেশও, একাধিকবার ‘আফটার শক’ অনুভূত | ৭ দিনে দু’বার কম্পন, ঝুঁকিতে দেশ
স্টাফ রিপোর্টার: চীনের প্রত্যন্ত তিব্বত অঞ্চলে আঘাত হেনেছে শক্তিশালী ভূমিকম্প। সেখানে নিহত মানুষের সংখ্যা অন্তত: একশ’। বহু মরদেহ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভূমিকম্পে অনেক ঘরবাড়ি-ভবন ধসে পড়েছে। ভূমিকম্পে সাত সকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাও কেঁপে উঠেছে। প্রভাব পড়েছে ভারত-নেপালসহ বিভিন্ন দেশে। এ নিয়ে চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম ৭ দিনে দেশে দুবার ভূমিকম্প অনুভূত হলো। দুটোরই উৎপত্তিস্থল দেশের বাইরে হলেও এ নিয়ে দেশজুড়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় রয়েছেন সাধারণ মানুষ। সিলেটেও কম্পন অনুভূত হয়েছে, তবে অনেকেই টের পাননি। বহুতল ভবনের বাসিন্দাদের মাঝে এ নিয়ে আতংক দেখা দিয়েছে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (ইউএসজিএস) বলছে, রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ১। চীনের ভূমিকম্প নেটওয়ার্ক সেন্টার (সিইএনসি) বলেছে, স্থানীয় সময় মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৫ মিনিটে (বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা ৫ মিনিট) এই ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল প্রতিবেশী দেশ নেপালের সীমান্তবর্তী তিব্বতের ডিংরি কাউন্টি।
চীনের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম সিসিটিভি বলেছে, ডিংরি কাউন্টি ও এর আশপাশের এলাকায় তীব্রভাবে শক্তিশালী এই ভূমিকম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের উৎপত্তি স্থলের কাছের বেশ কয়েকটি ভবন ধসে পড়েছে। ভূমিকম্পের পর অঞ্চলটিতে একাধিকবার পরাঘাত (আফটার শক) অনুভূত হয়। রিখটার স্কেলে পরাঘাতের সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৪। সিনহুয়ার খবরে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি পর্যবেক্ষণে স্থানীয় প্রশাসন থেকে ডিংরি কাউন্টির শহরতলিগুলোতে লোক পাঠানো হয়েছে। তিব্বত অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু এই কাউন্টিতে প্রায় ৬২ হাজার মানুষ বসবাস করেন। এটি মাউন্ট এভারেস্টের চীনা অংশে অবস্থিত। এই অঞ্চলে নিয়মিত ভূমিকম্প হয়।
এক সপ্তাহে দেশে দু’বার ভূমিকম্প অনুভূত :
চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম সাত দিনে দেশে দুবার ভূমিকম্প অনুভূত হলো। এর মধ্যে মঙ্গলবার সকালে অনুভূত হওয়া ভূমিকম্প ছিল তীব্র ধরনের। আর ৩ জানুয়ারি হওয়া ভূমিকম্পটি ছিল মাঝারি মাত্রার। দুই ভূমিকম্পের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হলো, দুটোরই উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশের বাইরে। গতকালের উৎপত্তিস্থল চীনের জিজাং এলাকা। আর ৩ জানুয়ারির ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের হোমালিন নামের একটি স্থান। এক সপ্তাহে দেশে দুবার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার বিশেষ কোনো তাৎপর্য আছে কি?
৩ জানুয়ারি হওয়া ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৪৮২ কিলোমিটার দূরে। আর গতকাল যেখানে উৎপত্তি হয়েছে, সেই চীনের জিজাংয়ের দূরত্ব ঢাকা থেকে ৬১৮ কিলোমিটার দূরে। এত দূরে উৎপত্তি হওয়া দুটি ভূমিকম্পের আদৌ কি কোনো প্রভাব বাংলাদেশে আছে, এর উত্তরে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণাকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবায়েত কবীর বলেন, এত দূরে উৎপত্তি হওয়া দুটো ভূমিকম্পের তেমন কোনো প্রভাব আমাদের এখানে নেই। শুধু কম্পন অনুভূত হয়েছে। কোনো ক্ষয়ক্ষতিও নেই। তবে গতকালের ভূমিকম্পটি মানমাত্রার দিক থেকে তীব্র। তাই অনেক দূরে এর উৎপত্তি হলেও বাংলাদেশ থেকে অনুভূত হয়েছে।
ভূমিকম্পটির মাত্রা রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ১। আর গত শুক্রবারের (৩ জানুয়ারি) ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৫। এ ভূমিকম্প শুধু চীন নয়, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ থেকে একযোগে অনুভূত হয়েছে। বস্তুত এর মাত্রা তীব্র হওয়ার কারণেই দূর থেকেও এটি অনুভূত হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ঝুঁকিতে দেশ :
বেশ কয়েকটি সক্রিয় ফল্ট লাইনসহ টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান দেশটিকে উল্লেখযোগ্য ঝুঁকিতে ফেলেছে। ঐতিহাসিকভাবে, এই অঞ্চলে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়েছে, ১৮৬৯ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে পাঁচটি বড় ঘটনা রিখটার স্কেলে সাত দশমিক শূন্যের উপরে নিবন্ধিত হয়েছে। এরপর থেকে উচ্চ মাত্রার ভূমিকম্প স্তিমিত হয়ে আসছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে ভূমিকম্পের বিপর্যয়ের আগে এই নীরবতা থাকতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমিকম্পের আঘাত উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। ২০২৪ সাল থেকে রেকর্ড করা ৬০টি ভূমিকম্পের মধ্যে তিনটি চার দশমিক শূন্য মাত্রার উপরে এবং ৩১টি তিন দশমিক শূন্য থেকে চার দশমিক শূন্যের মধ্যে ছিল। এই ঊর্ধ্বগতি, শহর এলাকায় বিস্তৃতি এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর সাথে সম্পর্কিত জাতিকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে তুলে ধরে। ভূমিকম্পে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের তালিকায় ঢাকা অন্যতম। ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের ঘটনা ঘটে। এতে এক হাজার একশ’ জনেরও বেশি লোক প্রাণ হারায়। এই ঘটনাটি দুর্বলভাবে নির্মিত ভবনগুলোর সৃষ্ট বিপদের একটি ভয়াবহ উদাহরণকে তুলে ধরে।
২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, রামপুরা, মতিঝিল ও খিলগাঁওয়ের মতো এলাকার অনেক স্থাপনা কাঠামোগত ও নকশার মান পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব এলাকায় একটি উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ঢাকায় অকল্পনীয় মাত্রার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
কার্যকর উদ্যোগের আহ্বান :
আন্তঃদেশীয় মূল্যায়ন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসাবে চিহ্নিত হলেও বিশেষজ্ঞরা ঝুঁকি কমাতে একটি সমন্বিত, বহুমাত্রিক ক্ষেত্রভিত্তিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। মূল সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে: শক্তিশালী বিল্ডিং কোড প্রয়োগ করা। ভূমিকম্প প্রস্তুতি সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো। গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো পুনর্র্নিমাণের জন্য সম্পদ বরাদ্দ করা। দক্ষতার সাথে বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য বেসামরিক-সামরিক সমন্বয় বৃদ্ধি করা।