শায়খুল হাদিস মুকাদ্দাস আলী’র ইন্তেকাল
প্রকাশিত হয়েছে : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ৬:০৮:৫৩ অপরাহ্ন
জকিগঞ্জ প্রতিনিধি :
একাধারে ৬৯ বছর বুখারী শরীফের শিক্ষাদানের বিরল দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
বুধবার (৮ জানুয়ারী) সকাল ৮ টায় তার নিজ বাড়ি জকিগঞ্জ উপজেলার সোনাসার এলাকার বারগাত্তা গ্রামের বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তিনি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার বারগাত্তা গ্রামে ১৩৪০ বাংলার ২০ চৈত্র আনুমানিক ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। মরহুমের জানাযার নামাজ বুধবার বিকাল সাড়ে ৪ টায় তার নিজ গ্রামের পার্শ্ববর্তী সোনাসার বাসস্টেশনের পূর্ব মাঠে অনুষ্ঠিত হয়।
তার মৃত্যুতে পুরো সিলেটজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিজ এলাকার মানুষের কাছে ‘মাটির ফেরেশতা’ নামে খ্যাত শায়খুল হাদিস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী একজন নিভৃতচারী বুজুর্গ ছিলেন। পার্থিব দুনিয়ার মোহ-মহব্বত ছিলনা তার মাঝে। কিতাব অধ্যয়নেই তার ছিল সব আনন্দ-আহ্লাদ। সব প্রশান্তি যেন ছিল সাদা কাগজের কালো হরফগুলোতে, যেখানে লেখা রয়েছে কোরআন মাজিদের আয়াত, তাফসির ও হাদিসের বাণী। জীবনের শেষ সময়ে বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়লেও কিতাবের মায়া এবং ছায়ায় ছিলেন ফুরফুরে। একদিকে যেমন ইলমে হাদিসের ওপর অগাধ পাণ্ডিত্য, অন্যদিকে নিভৃতচারিতা ও বুজুর্গিতে অতুলনীয় ছিলেন সিলেটের এই মহান বুজুর্গ। টানা ৬৯ বছর ধরে তিনি সিলেটের নিভৃত পল্লীতে থেকে হাদিসশাস্ত্রের সবচেয়ে বিশুদ্ধ সংকলন সহিহ বোখারি শরিফের দরস প্রদান করে আসছিলেন।
শিক্ষাজীবনে শায়খুল হাদীস আল্লামা মুকাদ্দাস আলী প্রথমে স্থানীয় সোনাসার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাশাপাশি মসজিদের ইমাম মাওলানা মাহমুদ হুসাইনের কাছে কায়দা-আমপারাসহ দ্বীনের বুনিয়াদি শিক্ষা অর্জন করেন। দ্বীনি শিক্ষার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল বিধায় স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে চলে যান ফুফুর বাড়িতে। ভর্তি হন মাদ্রাসায়ে সাইদিয়া ভরন সুলতানপুরে। সেখানে এক বছর লেখাপড়ার পর নানাবাড়ি চলে যান। ১৩৬৭ হিজরিতে নানা তাকে ভর্তি করিয়ে দেন বর্তমান ভারতে অবস্থিত বছলার মারকাজুল উলুম ভাঙ্গা মাদ্রাসায়। এখানে নাহবেমীর থেকে জালালাইন পর্যন্ত একটানা আট বছর পড়াশোনা করেন। এরপর উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে ১৩৭৪ হিজরিতে চলে যান উপমহাদেশের অন্যতম দ্বীনি মারকাজ দারুল উলুম দেওবন্দে। পুনরায় ভর্তি হন জালালাইন জামাতে। দেওবন্দে তিন বছর ‘ফুনুনাত’ পড়ে ১৩৭৭ হিজরিতে ভর্তি হন দাওরায়ে হাদিসে। বোখারি শরিফের দারস ও সনদ গ্রহণ করেন হজরত ফখরুদ্দিন মুরাদাবাদী (রহ.)-এর কাছ থেকে। এ ছাড়া আল্লামা ইবরাহিম বালিয়াভি (রহ.)-এর কাছে সহিহ মুসলিম ও সুনানে তিরমিজি, মাওলানা ফখরুদ্দিন মুরাদাবাদি (রহ.)-এর কাছে সুনানে আবু দাউদ, মাওলানা জহুরুল হক (রহ.)-এর কাছে শরহে মাআনিল আসার, মাওলানা সাইয়্যিদ হাসান (রহ.)-এর কাছে সুনানে ইবনে মাজাহ, কারি তৈয়্যব (রহ.)-এর কাছে মুআত্তাইন কিতাব পড়েন এবং ইজাজত পান।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর আল্লামা মুকাদ্দাস আলী দেশে ফিরে আসেন। এরপর ১৩৭৯ হিজরি ১৯৬০ সালে জন্মভূমি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার মুনশিবাজার মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের শুরু হয়। তখন মুনশিবাজার মাদ্রাসায় হাদিসের জামাত ছিল না, ফলে মিশকাতুল মাসাবিহ, তাফসিরে বয়জাবিসহ গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদি পাঠদান করেন। পরের বছরই সেখানে দাওরায়ে হাদিস খোলা হয় এবং প্রত্যাশিতভাবে তরুণ মাওলানা মুকাদ্দাস আলী শায়খুল হাদিসের মসনদ অলংকৃত করেন। সেই থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৬৯ বছর ধরে সহিহ বোখারির দরস দিয়ে আসছিলেন।
পারিবারিক জীবনে মাওলানা মুকাদ্দাস আলী ১৩৮১ হিজরিতে জকিগঞ্জের পরচক নিজগ্রামের মুহিবুর রহমানের বড় মেয়ে আনোয়ারা বেগমের সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। আট সন্তানের মধ্যে তিন মেয়ে শৈশবেই মারা যান। বর্তমানে তিন ছেলে আর দু’জন মেয়ে রয়েছেন। দুই ছেলে আলেম, হাফেজ এবং দ্বীনি খেদমতে নিয়োজিত আছেন।