প্রধান উপদেষ্টার সাথে সর্বদলীয় বৈঠক : জুলাই ঘোষণাপত্রে ঐকমত্য
প্রকাশিত হয়েছে : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১০:০৮ অপরাহ্ন
একতাতেই আমাদের জন্ম, একতাতেই শক্তি : ড. ইউনুস
জালালাবাদ রিপোর্ট : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টার সাথে অনুষ্ঠিত হলো সর্বদলীয় সভা। এতে আলোচিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে সব দল।বৈঠকে অংশ নেন বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারাও।বৈঠক শুরুর আগে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপির প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল বৈঠকে অংশ নেন। দলের অন্যদের মধ্যে ছিলেন, সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল।
বৈঠকে অংশ নেওয়া অন্য দলের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন- গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মাদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ও সংগঠনটির মূখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ।
বৈঠকের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ৫ আগস্ট ছিল আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতীক। ওইদিন পুরো অনুভূতিটাই ছিল একতার অনুভূতি। এখন কিছু করতে হলে সবার মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে। কেউ যেন বলতে না পারে, তুমি অমুক, তুমি তমুক। কাজেই জুলাই ঘোষণাপত্র সবার মতামতের ভিত্তিতে করতে চাই। ড. ইউনূস বলেন, এ সরকারের জন্ম হয়েছে ঐক্যের মাঝখানে, ঐক্যের দ্বারা এটা সৃষ্টি। যখন আমরা নিজেরা নিজেরা কাজ করি, তখন দেখি একা পড়ে গেছি, আশেপাশে কেউ নেই আপনারা। তখন একটু দুর্বল মনে করি। যখন আবার সবাই একসঙ্গে কাজ করি তখন মনের মধ্যে সাহস বাড়ে, একতাবদ্ধভাবে আছি। একতাতেই আমাদের জন্ম। একতাতেই আমাদের শক্তি।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, একদিন ছাত্ররা এসে বললো তারা ঘোষণাপত্র দেবে। আমাকেও সেখানে থাকতে হবে। বুঝতে চাইলাম কী ঘোষণাপত্র দিচ্ছে, বললো। আমি বললাম এটা হবে না। আমার চাওয়াটা হবে না, তোমাদের চাওয়াটাও হবে না। তোমরা যদি ৫ আগস্টে ফিরে যেতে চাও, সেদিনের পরিপ্রেক্ষিতে যা হয়েছিল সেটাকে রিক্রিয়েট করতে হবে। একা এটা করা যাবে না। ওইদিনের পুরো অনুভূতিটাই ছিল একতার অনুভূতি। কেউ বলে নাই তুমি অমুক, তুমি তমুক। তখন যে একতা দিয়ে তোমরা ৫ আগস্ট সৃষ্টি করেছিলে সেটার অবমাননা হবে। তারা আমার কথায় খুব খুশি হয়নি। কিন্তু ক্রমে তারা বুঝলো ৫ আগস্ট রিক্রিয়েট করতে হলে এইভাবে করতে হবে। সেই কথা থেকে এ আলাপ শুরু। আজকে আলোচনা একে কেন্দ্র করেই হবে। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে করতে না পারলে উদ্দেশ্যে ব্যাহত হবে।
এদিকে বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বৈঠক জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন।
সবাই বলেছেন, এই ধরনের একটা ঘোষণাপত্র করার দরকার আছে। তবে এখানে অনেক সাজেশন আসছে- মোটা দাগে হলো- ঘোষণাপত্রে সবার অবদান বলতে হবে, ধারাবাহিকতা উল্লেখ করতে হবে। তবে এটি তৈরিতে তাড়াহুড়া কিংবা কালক্ষেপণ যেন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। যত সময়ই লাগুক না কেন ঘোষণাপত্রটি ভালোভাবে যেন তৈরি করা হয়। তাড়াহুড়া যেন না করা হয়, আবার কালক্ষেপণও যেন না হয়।
‘কোথাও অনৈক্যের সুর’ নেই উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, বৈঠকে শুধুমাত্র পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন মতামত এসেছে। সবাই যেন অনুভব করে যে এই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের মালিকানা তারও আছে, সে ব্যাপারে বিভিন্ন মতামত এসেছে। এটি সুদৃঢ় ঐক্যের পথে সহায়ক হবে।
যা বলল বিএনপি :
বৈঠক শেষে বেরিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র ঘিরে যাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি না হয়, সেদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে লক্ষ্য রাখতে বলেছেন তাঁরা।একইসঙ্গে সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কি না, সে প্রশ্নও করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির এই নেতা।তিনি বলেন, যদি কোনো রাজনৈতিক দলিল ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়, সেই দলিলটাকে বিএনপি অবশ্যই সম্মান করে। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়, সেই পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঐক্যকে গণঐক্যে রূপান্তরিত করে সেটাকে আমরা যাতে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে চর্চা করতে পারি, সেই ঐক্যকে ধরে রেখে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি, সেটাই আমাদের এখনকার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমাদের সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক বক্তব্য আমরা দিতে চাই। কোনো ফ্যাসিবাদী শক্তি বা ফ্যাসিবাদের দোসরেরা যাতে আমাদের ভেতরে অনৈক্যের বীজ বপন করতে না পারে, সেদিকে আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের আহ্বান করেছিলেন, আমরা এসেছি, কথা বলেছি। আমরা আমাদের পরামর্শ, রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব চিন্তাভাবনা আমাদের দেওয়া প্রয়োজন, সেটা আমরা দিয়েছি।
এক প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সম্পর্কিত ঘোষণাপত্র নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের নেতারা তাঁদের পরামর্শমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। আমরা প্রশ্ন করেছি, আসলে সাড়ে পাঁচ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কি না। যদি থেকে থাকে, সেটার রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক এবং আইনী গুরুত্ব কী, সেগুলো নির্ধারণ করতে হবে। এ ঘোষণাপত্রকে কেন্দ্র করে যাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘যদি কোনো রাজনৈতিক দলিল ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়, সেই দলিলটাকে আমরা অবশ্যই সম্মান করি। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়, সেই পরামর্শ আমরা দিয়েছি। ঘোষণাপত্রের খসড়া নিয়ে কোনো আপত্তি আছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে উত্তর না দিয়েই সালাহউদ্দিন আহমদ চলে যান।
যা বলল জামায়াত :
জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সব রাজনীতিক দল একমত হয়েছে জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সব রাজনীতিক দলই জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে একমত। তবে তাড়াহুড়ো করতে গেলে অভ্যুত্থানের চেতনার ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে।প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানে সর্বদলীয় সংলাপ শেষে কথা বলেন অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।জামায়াত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের কাঠামোগত দিক নিয়ে আরও আলোচনা দরকার। এটা প্রাথমিক আলোচনা। জুলাই ঘোষণাপত্র রচনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে মতবিনিময়ের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছিল। সর্বদলীয় বৈঠকে আমরা আমাদের মতামত পেশ করেছি। মোটা দাগে আলোচনার বিষয়ে বলতে গেলে, প্রথমত জামায়াতে ইসলামীসহ সব রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐক্য ধারণ করার জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রনয়ণ করা হোক, এ বিষয়ে একমত।
তবে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে দু’দিন আগে থেকে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া খসড়াগুলো অনেকেই সময়মতো পায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা পরামর্শ দিয়েছি সরকারের এমন একটি মূল্যবান দলিল তৈরির পেছনে কোনো অস্থিরতা, অসংগতি বা সমন্বয়হীনতার প্রয়োজন নেই। ধীরস্থিরভাবে আমাদের এই ঘোষণাপত্র প্রণয়নের জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় হওয়া দরকার।মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আমরা পরামর্শ দিয়েছি, সরকারের এমন মূল্যবান ঘোষণাপত্রের জন্য আরও মতবিনিময় হওয়া দরকার। তবে ঘোষণাপত্রের খসড়ায় অনেক মৌলিক জিনিস বাদ পড়েছে। বাংলাদেশে ইসলামী শক্তি বড় একটি শক্তি, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে তাদের অসাধারণ ত্যাগ, বহু মানুষকে শহিদ করা হয়েছে, নিরীহ-নিরপরাধ নেতৃবৃন্দকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছে, গুম করা হয়েছে, ক্রসফায়ার নেয়া হয়েছে- এই সত্য ইতিহাসগুলো ঘোষণাপত্রের কাঠামোয় স্থান পায়নি। ইতিহাস থেকে এমন মৌলিক বিষয়গুলো যেন বাদ না পড়ে আমরা সেগুলো সরকারের দৃষ্টিতে এনেছি। আমরা বলেছি- প্রক্রিয়াটা এমন হওয়া দরকার যাতে সব দলসহ স্টেকহোল্ডাররা মতামত দিতে পারে।