সংস্কার কমিশনের সুপারিশ : বাস্তবায়ন কতটা চ্যালেঞ্জের?
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১০:৪৩ অপরাহ্ন
জালালাবাদ রিপোর্ট : অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ৪ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ জমার সপ্তাহ পার হয়েছে। এখনো জমা দেয়নি অন্য সংস্কার কমিশনগুলো। তবে কমিশন সুপারিশসহ রিপোর্ট দিলেও এসব সুপারিশ কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে বা কি কি বিষয় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে- তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও সরকার বলছে, সুপারিশ নিয়ে ফেব্রুয়ারীতে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সাথে সংলাপে বসা হবে।
তবে সবার অগে যে চ্যালেঞ্জ সামনে এসছে তা হলো, কিছু কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আর কিছু সুপারিশ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করতে পারলেও গত ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে যা কিছুই হচ্ছে সবই আগামী সংসদে অনুমোদন করাতে হবে।
ফলে অনেকের মধ্যে এই সংশয়ও আছে সংস্কার বিষয়ক সব সুপারিশ পরবর্তী সংসদ নাও গ্রহণ করতে পারে। রাজনৈতিক দল, বিশ্লেষক ও সংস্কার কমিশনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদের কেউ কেউ বলছেন, সুপারিশগুলো সব দলের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে কিংবা তাদের মধ্যে যদি ন্যূনতম ঐকমত্য না হয়, তাহলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সুপারিশ শেষ পর্যন্ত ‘কাগজেই থেকে যেতে পারে’।
প্রশ্ন উঠেছে কমিশনের দেয়া সংস্কার কতোটুকু মেনে নেবে রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ ইতিমধ্যে বিএনপি সংবিধান সহ কয়েকটি খাতের সংস্কার নিয়ে নিজেদের আপত্তি জানিয়েছে। তারা বলছেন, সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। তাই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংস্কার করতে পারা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিষয়টি নিয়ে ভাবছে সরকারও।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু স্পষ্ট করে জানিয়েছেন ‘কি সংস্কার হবে বা কতটা সংস্কার হবে’ তা ঠিক করবে কেবলমাত্র সংসদ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিরা’। অন্যদিকে, চার কমিশনের সুপারিশ জমার পর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা সমীচীন নয় বলে জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, এটা চূড়ান্ত কিছু নয়, কমিশনের প্রস্তাব। সরকার রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনদের সঙ্গে যখন সংলাপের আয়োজন করবে, তখন সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে আমরা আমাদের মতামত দেব। তার আগে মতামত দেওয়া সমীচীন হবে বলে মনে করি না।
ওদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ে সংস্কার কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ডঃ ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, রাজনৈতিক দল ও সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপরই নির্ভর করবে শেষ পর্যন্ত এগুলোর কিছু বাস্তবায়ন হবে কি না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলছেন, সামগ্রিক সংস্কার ইস্যুর ভবিষ্যতটা শেষ পর্যন্ত জনগণের ম্যান্ডেটের ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার জের ধরে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংস্কার ইস্যুটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসলেও শেষ পর্যন্ত দলগুলোর মধ্যকার গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে তা খুব একটা বাস্তবায়ন হয়নি। তখন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (রিপ্রেজেন্টেটিভ পিপলস অর্ডার ১৯৭২) বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হলেও নির্বাচনি কার্যক্রমে তার যথাযথ প্রয়োগ কখনোই হয়নি বলে অভিযোগ আছে।
আবার ২০২৩ সালে এর যে সংশোধনী আনা হয়েছে তাতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছিলো বলেও অনেকে মনে করে থাকেন।
সংস্কার সুপারিশ :
ছাত্র জনতার আন্দোলনে ২০২৪ সালের অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে জোরেশোরে উঠে এসেছে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সংস্কারের রূপরেখা নির্ধারণের জন্য সুপারিশ প্রণয়নের লক্ষ্যে এখন পর্যন্ত মোট ১১টি কমিশন গঠন করা হয়েছে।
এর মধ্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে সংবিধান সংস্কার কমিশন, বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশন, ডঃ ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন এবং সরফরাজ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে।
অন্যদিকে আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন আগামী ৩১ জানুয়ারি তাদের রিপোর্ট দেয়ার কথা।
এছাড়া গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন তাদের রিপোর্ট জমা দেয়ার জন্য আগামী ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় পেয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে সংবিধান সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট। সেই সাথে সুপারিশ দেয়ার আগেই জনপ্রশাসন সংস্কার কমিটি প্রধানের এক সংবাদ সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি প্রশাসন ক্যাডারের সাথে চরম বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলো অন্য ২৫টি ক্যাডার।
বিশেষ করে সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে বায়াত্তরের সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ অবশ্য বলছেন, সুপারিশগুলোর মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একনায়কতন্ত্রের পথ বন্ধ করার প্রয়াস নিয়েছেন তারা।
সুপারিশগুলো কী চ্যালেঞ্জে পড়বে?
দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার বিষয়ক কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাই হবে কেন্দ্রীয় ভূমিকা। রাজনৈতিক দল, অন্তর্বর্তী সরকার, ছাত্ররা, সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্র সবার মধ্যে ঐকমত্য হতে হবে। অন্তত কৌশলগত বিষয়ে একমত হতে হবে। তিনি বলেন, সব সংস্কার কর্মসূচির জন্যই রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন জরুরি। নতুন বাংলাদেশের যে ভিশন তা নিয়ে অঙ্গীকারটাও জরুরি। না হলে এসব কিছু কাগজে কলমে থেকে গেলেও আমি অবাক হবো না।
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান বলছেন, বাংলাদেশে সংস্কারের প্রসঙ্গ আগেও এসেছে কিন্তু রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করেনি বরং নিজেদের ইচ্ছে মতো সংবিধান সংশোধন করেছে। সব দল একমত হয়েছে কি-না তাও নিশ্চিত না। হয়তো সুপারিশগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। তখন দেখা যাবে তারা একমত হতে পারেন কি-না। সব রাজনৈতিক দলের এই একতাটাই প্রথম চ্যালেঞ্জ। তবে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন নির্ভর করবে জনগণের ম্যান্ডেটের ওপর।